ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

নারিকেলের ক্ষতিকারক সাদা মাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত

মো. লিখন ইসলাম, বাকৃবি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪  
নারিকেলের ক্ষতিকারক সাদা মাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত

দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল নারিকেল। এক সময় গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কম-বেশি নারিকেল গাছ ছিল। এর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছিল অনেক ছোটখাট শিল্প। তবে সম্প্রতি নারিকেল উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। মরছে গাছ, কমেছে ফলন। 

বিভিন্ন কারণে দিনদিন নারিকেলের ফলন কমছে। এর পেছনে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ অন্যতম। রুগোস স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই (বৈজ্ঞানিক নাম আলিউরিডিকাস রুজিওপারকিউলেটাস), যা নারিকেলের সাদা মাছি নামে পরিচিত। এটি একটি এক্সটিক বা বিদেশি পোকা। এ পোকাটি বাংলাদেশের নারিকেল শিল্পে এক রকম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ২০১৯ সালে দেশে সর্বপ্রথম বারির কীটতত্ববিদগণ নারিকেল চাষীদের সর্বনাশা এ সাদা মাছির উপস্থিতি শনাক্ত করেন ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক বাংলাদেশে নারিকেল গাছে ক্ষতিকারক সাদা মাছির আরো একটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছেন। গবেষণা দলের সদস্যরা সাদামাছির বিভিন্ন প্রজাতি শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাটে গেলে সেখানে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। এই নতুন প্রজাতির সাদা মাছির বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্যারালেইরোডেস বোন্দারি’, যা বাংলায় বলা হয় ‘বোন্দার নেস্টিং সাদামাছি’।

এ সাদা মাছির বিষয়ে রাইজিংবিডি ডটকমকে জানিয়েছেন গবেষক দলের প্রধান ও বাকৃবির কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস। গবেষণা সহকারী হিসেবে রয়েছেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা। 

২০২৩ সালের মে মাস থেকে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে ‘রুগোজ স্পাইরালিং হোয়াইটফ্লাই এর বায়ো-ইকোলজি এবং মরফো-মলিকুলার অধ্যয়ন এবং গবেষণাগারে এ পোকার বিরুদ্ধে কিছু নতুন জেনারেশনের কীটনাশকের কার্যকারিতা মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণা শুরু হয়।

গবেষকরা জানিয়েছেন, সাদা মাছির আক্রমণে রাতারাতি নারিকেল গাছের পাতা সাদা হয়ে যায় এবং ভেতরের পানি শুকিয়ে নারিকেলের আকার ছোট হয়ে যায়। সাদা মাছি নারিকেলের পাতার নিচের অংশ থেকে রস শুষে খেয়ে ফেলে। একইসঙ্গে অনর্গল ‘হানি ডিউ’ অথবা আঠাল মধুর ন্যায় মিষ্ট তরল নিঃসরণ করতে থাকে। এ হানি ডিউ আশেপাশের এবং নিচের পাতায় পড়ার পর তার উপর ‘ব্ল্যাক শুটি মোলড’ বা কালো রঙের ছোপ বিশিষ্ট ছত্রাক বাসা বাঁধে। এর ফলে, গাছের পাতার উপরিভাগ সম্পূর্ণ কালো আস্তরণে ঢেকে যায় এবং তা গাছের সালোক সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় বাঁধা প্রদান করে। 

প্রধান গবেষক ড. গোপাল দাস বলেন, “আমরা দেশব্যাপী জরিপের মাধ্যমে এ পোকার ৬১টি পোষক উদ্ভিদ শনাক্ত করেছি, যা আমেরিকার একটি জার্নালে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা এ পোকার বায়ো-ইকোলজি, প্রজাতি সনাক্তকরণ এবং এর ওপর বিভিন্ন জৈব-বালাইনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করছি।”

তিনি বলেন, “প্রজাতি সনাক্তকরণের জন্য আমরা দেশের ৩০টি এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোন থেকে সাদা মাছি সংগ্রহ করেছি। এর ধারাবাহিকতায় যশোর, খুলনা এবং বাগেরহাটের নারিকেল গাছ থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করে গবেষণাগারে আনা হয়। পরবর্তীতে এ সাদা মাছিগুলোর মর্ফোলজিক্যাল বা বাহ্যিক বৈশিষ্ঠ্য গবেষণাগারে অধ্যয়ন করা হয় এবং সেখানে কিছু ভিন্ন প্রজাতির সাদামাছির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।”

বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, “নতুন প্রজাতির সাদা মাছি আকারে খুব ছোট এবং নারিকেলের সাদা মাছির প্রায় অর্ধেক (১.১ থেকে ১.২ মিলিমিটার লম্বা)। এ পোকাটির সামনের পাখায় ক্রস-চিহ্নযুক্ত ধূসর বর্ণের ব্যান্ড রয়েছে। অন্য সাদা মাছি স্পাইরাল আকারে ডিম পারে। তবে এটি মোম ও তুলা দিয়ে পাখির মত বাসা তৈরি করে সেখানে ডিম পাড়ে। এদের ডিমে পাতার বোটার মত থাকে, যা অন্য সাদামাছিতে দেখা যায় না।”

তিনি আরও বলেন, “এদের পিউপেরিয়াম সমতল এবং কোন লেজের মত প্রজেকশন থাকে না। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সনাক্ত করা হলেও মলিকুলার অধ্যয়নের কাজ চলমান রয়েছে। অন্যান্য যেসব এগ্রো-ইকোলোজিক্যাল জোন থেকে সাদামাছি সংগ্রহ করা হয়েছিল সেখানে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।” 

ড. গোপাল বলেন, “২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে এ মাছি শনাক্ত করা হয়। পরে ২০২৪ সালের প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কায়ও এ মাছির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয় । তবে বোন্দার নেস্টিং সাদা মাছির পোষক উদ্ভিদ, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এটির আক্রমণের তীব্রতা এবং ক্ষতির মাত্রা কেমন সেসব বিষয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।”

তিনি বলেন, “ভারত ও শ্রীলংকার কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এ নতুন পোকাটির ডিম পাড়ার সময়কাল ও প্রজনন সক্ষমতা নারিকেলের সাদামাছির থেকেও বেশি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারিকেলের সাদামাছির সংখ্যা কমে গিয়ে বোন্দার নেস্টিং সাদামাছির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের জলবায়ুর ধরণ মোটামুটি ভারতের মতো হওয়ায় বাংলাদেশেও এ পোকাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং নারিকেলের উৎপাদন আরো হুমকির মুখে পড়তে পারে।”


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়