ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দার্জিলিংয়ের পথে-০৮

দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত রেল স্টেশন ঘুম

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দার্জিলিংয়ের বিখ্যাত রেল স্টেশন ঘুম

ঘুম স্টেশনে ঘুমাচ্ছে টয় ট্রেন

উদয় হাকিম : আবারো বৃষ্টি। রাতভর বৃষ্টি। এটি দার্জিলিংয়ে আমাদের চতুর্থ রাত। দুদিন গেলো রোদ্দুর। দুদিন বৃষ্টি। ডিনার শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিজলি বাতির মৌন আলোয় উদ্ভাসিত শহরটা। জলের ছাঁটে দৃষ্টি খুব একটা দূরে যায় না। বৃষ্টির একটানা শব্দ। বৃষ্টির কারণে অনেক জায়গাতেই যেতে পারলাম না, ভালোই জব্দ।

পঞ্চম দিন সকালেও বৃষ্টি নিয়েই ঘুম ভাঙলো। গাইড পার্থ বলছিলেন, আগের দিন যেসব জায়গা মিস করেছিলাম সেগুলোতে ওইদিন যাব। তবে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছতে হবে কালিম্পং। লাঞ্চের শিডিউল সেখানেই। সকাল সকাল নাস্তা সেরে জিপে। বৃষ্টি তখনো টিপ টিপে।

প্রথম দিন শিলিগুড়ি থেকেই শুনেছিলাম, দার্জিলিংয়ে ন্যারো গেজের (২ ফিট, ৬১০ মিলিমিটার) যে রেল লাইন; তাতে ট্রেন চলে সপ্তাহে দুদিন। এটি টয় ট্রেন নামে পরিচিত। যদিও চারদিনেও ট্রেনের দেখা পাইনি। শুধু লাইন আর স্টেশন দেখাই সার!

প্রথম সন্ধ্যাতেই পার্থ দেখিয়েছিলেন- ঘুম রেল স্টেশন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা। তার একপাশে ছোট্ট স্টেশন। ছোট্ট ছাউনি। পিঙ্ক কালারের। এ ক’দিন এর পাশ দিয়েই বার কয়েক যাওয়া আসা করেছিলাম। প্ল্যান ছিলো এখানে একটা গ্রুপ ছবি হবে আমাদের। কিন্তু সময়- সুযোগ হচ্ছিলো না। শেষ ইচ্ছে ছিলো পঞ্চম দিন সকালে সেটা হবে। কিন্তু কীভাবে? বৃষ্টি তো থামছেই না। ছাউনির নিচেও আলো কম। 

হোটেল থেকে ঘুম স্টেশনে যাওয়ার আগেই দেখা পেয়ে গেলাম ট্রেনের। গাড়ির রাস্তার পাশেই টয় ট্রেন লাইন। প্রথমে আমাদের বাম পাশে দেখলাম। একটু পরই ক্রস করে ডানে চলে গেলো। মাত্র তিনটি বগি। যাত্রী সবে মিলে শ’খানেক। রাস্তা এবং লাইনের মাঝে কোনো ডিভাইডার নেই। আবার ট্রেন যখন আমাদের ক্রস করে অন্য পাশে সড়ক পার হচ্ছিলো, দেখলাম মূল সড়কে কোনো ব্যারিকেড বা গেট নেই। আমাদের জিপ দাঁড়ালো। ও পাশের গাড়িও দাঁড়িয়ে গেলো। ট্রেন রাস্তা ক্রস করলো।

দার্জিলিংয়ের ঘুম রেল স্টেশনে জাহিদ হাসান এবং লেখক


আমাদের জিপের পাশ দিয়েই টয় ট্রেন যাচ্ছিলো। ট্রেনের চেয়ে জিপের গতিই বেশি। কিন্তু আবারো ট্রেন চলে গেলো ডানে। দেখতে পাচ্ছিলাম ডান পাশে সামনেই স্টেশন। সেখানেই ট্রেন ঢুকে যাচ্ছিলো। ভেতরের লোকজন অনেকেই দাঁড়িয়ে। একপাশে সিট একটা, অন্যপাশে ২ টা। ভেতরের লোকজনকে দেখে মনে হচ্ছিলো, খাঁচায় পুরে পাখিদের নেয়া হচ্ছিলো কোথাও। মুরগির মতো ঠোঁট বের করে বাইরে তাকিয়ে। এর কারণ আছে। সাধারণত মানুষ শখ করে, ইতিহাসের অংশ হতে, কিংবা খেলা বা বিনোদনের জন্য এই ট্রেনে চড়ে।

কালিম্পং যাওয়ার পথে জিপ গিয়ে থামলো ঘুম রেল স্টেশনের পাশে। বৃষ্টি হচ্ছিলো। তাই অন্যরা নামলো না। ভো দৌঁড় দিয়ে রাস্তা পার হলাম। জাহিদ হাসান একটা লুঙ্গি মাথায় দিয়ে গেলেন। অন্যরা বসে রইলেন জিপে।

বৃষ্টিতে ভিজে হলেও ঘুম স্টেশন পরিদর্শন পরিত্যাগ করিনি। তার কারণ আছে। এটি আসলে একটি ঐতিহাসিক স্টেশন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখকরা এই স্টেশনে এসেছেন। এর কথা লিখেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এখানে এসেছেন। তাই মিস করতে চাইনি।

দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথ বেয়ে এই রেল লাইন শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ট্রেন পরিচালনা করে যে সংস্থা তার নাম দার্জিলিং হিমালয়ান রেল কর্তৃপক্ষ। ১৮৭৯ থেকে ১৮৮১ সালে এই পথ নির্মাণ করা হয়েছিলো। এর দৈর্ঘ্য ৮৬ কিলোমিটার। পথের উচ্চতা শিলিগুড়িতে ৩২৮ ফুট। আর দার্জিলিংয়ে ৭৪০৫ ফুট। ভারতের সর্বোচ্চ রেল পথ এটি। দ্বিতীয় স্থানে আছে শিমলা। এখানে দু ধরনের ট্রেন চলে। একটি বাষ্পচালিত। যার ভাড়া বেশি, ১৪০০ রূপি। আরেকটা ডিজেল চালিত, ভাড়া ৮০০ রুপি। তবে লাইন দেখে মনে হলো না এই ট্রেন শিলিগুড়ি যায়। ধারণা করলাম, ঘুম হয়ে বাতাসিয়া লুপ আর দার্জিলিং শহর চক্কর দিয়েই এটি ট্রিপ শেষ করে।

যাহোক ইতিহাস বলছে, ফ্রাঙ্কলিন প্রিস্টেজ নামে এক লোক শিলিগুড়ি এবং দার্জিলিংয়ের মধ্যে বাষ্পচালিত ট্রেন লাইনের প্রস্তাব করেন। ব্রিটিশ আমলের কথা। তখন বাংলার গর্ভনর ছিলেন স্যার এ্যাশলে ইডেন। সম্ভবত তার নামেই ঢাকার ইডেন কলেজ। তিনি প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। ১৮৭৮ সালে কোলকাতা- শিলিগুড়ি স্ট্যান্ডার্ড লাইনের মাধ্যমে এই দুটি শহর রেল সেবায় যুক্ত হয়েছিলো। ঠিক এর পরের বছরই ফ্রাঙ্কলিনের প্রস্তাবের পরপরই শিলিগুড়ি- দার্জিলিং ন্যারো গেজের কাজ শুরু হয়েছিলো। নির্মাণ কাজ করেছিলো গিলান্ডারস আরবার্থনট এ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৮০ সালে সালের ২৩ আগস্ট শিলিগুড়ি-কার্শিয়াং অংশ চালু হয়েছিলো। আগেই বলেছিলাম, শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে হয় এই কার্শিয়াং শহরের পাশ দিয়েই। দার্জিলিং পর্যন্ত লাইন চালু হয় ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই।

ঘুম মিউজিয়াম। পাশেই রেল স্টেশন


১৮৯৭ সালে ভূমিকম্প এবং ১৮৯৯ সালে ঘুর্ণিঝড়ে এই পথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এরপর ক্রমে রেলপথের চেয়ে সড়কপথ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দার্জিলিং ও ঘুমের একাধিক সেনা ক্যাম্পে রসদ সরবরাহ করা হয়েছিলো এই রেলপথ ব্যবহার করে।

১৯৮৮-৮৯ সালে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের কারণে এই পথ ১৮ মাস বন্ধ ছিলো। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগে একমাত্র অস্ট্রিয়ার সেমারিং রেলওয়ে ১৯৯৮ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পেয়েছিলো। সেদিক থেকে দার্জিলিং বা ঘুম দ্বিতীয়।

ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে স্টেশন। মাছি ঘুরছিলো। অপরিচ্ছন্ন মেঝে। বেঞ্চে কিছু লোক বসে ছিলো। স্বাভাবিক রেল স্টেশনের মতো ব্যস্ততা নেই। ছাউনি চুইয়ে কোথাও পানি পড়ছিলো। ট্রেনটি তখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে। যাত্রী তুলে আবারো যাত্রা শুরু করবে। প্রথমে ট্রেনের ছবি তুললাম। এরপর ইঞ্জিনের সামনে গিয়ে সেলফি নিলাম। রেলের একজন গার্ড এসে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ালেন পাশে। জাহিদ হাসানের কাছে মোবাইল দিলাম। তিনি আমাদের ছবি তুলে দিলেন।

খেয়াল করলাম স্টেশনের পাশের চত্বরটা কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে বড় একটা পুরনো ট্রেন বসে ছিলো। পুরনো ইঞ্জিন। ওই চত্বরের গেইটে একটি সাইনবোর্ড- দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে- ঘুম। প্ল্যাটফর্মের ঠিক উল্টোদিকেই মিউজিয়াম। ওই চত্বরের প্রবেশ মুখ আরেকটা সাইনবোর্ড- ঘুম মিউজিয়াম। অবশ্যই রেলওয়ে মিউজিয়াম। ভেতরে কি আছে? পুরনো ইঞ্জিন, পাত বা লাইনের ধাতব অংশ, ইতিহাস, দলিল দস্তাবেজ, ছবি ইত্যাদি।

সকাল বেলা দার্জিলিং শহরবাসীর যখন ঘুম ভাঙছিলো, তখন আমরা ঘুম ছাড়ছিলাম।


**




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৮/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়