ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মধুচন্দ্রিমার লামাহাটা, অনিন্দ্য সুন্দর ত্রিবেণী

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৮ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুচন্দ্রিমার লামাহাটা, অনিন্দ্য সুন্দর ত্রিবেণী

ত্রিবেণী ভিউ পয়েন্ট। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া

উদয় হাকিম : ২০১২ সালের কথা। মার্চ মাস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লামাহাটা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করছিলো। হঠাৎ থামলেন। রাস্তার পাশের কিছু ছবি নিলেন। বিশেষ করে পর্বতের গায়ে লেপ্টে থাকা গ্রাম; ছোট ছোট ঘর বাড়ি তাঁকে আকৃষ্ট করেছিলো।

মমতা দেখলেন, পাহাড়ি গ্রাম। উঁচু পাহাড় থেকে ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা সবুজে ছাওয়া মনোরম ভূমি। রাস্তার পাশে ধুপি আর পাইন বন। আশপাশে পাহাড়ের চূড়া। চমৎকার নদী। পরে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয়দের সহায়তায় অসাধারণ একটা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়েছে লামাহাটা। চায়ের বাগান, পাইন বন আর টুরিস্ট ল’জ দিয়ে অপরূপ সাজে সেজেছে জায়গাটি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের থেকে লামা আর হাট থেকে হাট্টা মিলে এরকম নামকরণ। জায়গাটির নাম লামাহাটা বা লামাহাট্টা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যকে ঠিক রেখেই এখানে সাজানো হয়েছে সবকিছু।

সত্যি! দার্জিলিংয়ের পাশের এই জায়গাটি, লামাহাটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। শুধু মমতা কেন, ভ্রমণ পিপাসু কোনো মানুষেরই ক্ষমতা নেই এমন সৌন্দর্য্যকে এড়িয়ে যাওয়ার।

স্থানীয় গাইড পার্থ বাসনেত জানালেন, এটি দার্জিলিং থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। নেটে অবশ্য পাওয়া গেলো ২৩ কিলো। ওই একই কথা। পূবে বলা চলে। তবে উত্তর ঘেঁষা। দার্জিলিংয়ের ঘুম রেল স্টেশন থেকে আবারো জিপে উঠলাম। যাচ্ছিলাম কালিম্পং। তখনো বৃষ্টি পড়ছিলো। টাইগার হিলে যাওয়ার রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। আর তাই ঘুম রেল স্টেশন, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম মনেস্ট্রি- সবই পথে পড়লো।

মনে পড়ছিলো টাইগার হিলের পাশের ডাক বাংলো পয়েন্টের কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গিয়ে পাহাড়ের উপরে মালভূমির মতো জায়গাটায় ছবি তুলেছিলাম আমরা। যেহেতু টাইগার হিলে গিয়েছি তাই টাইগার সংশ্লিষ্ট একটা স্মৃতিচিহ্ন রাখা দরকার। ফিরোজ আলম সবাইকে ডাকলেন। সেলফি স্টিকে মোবাইল সেট করে দাঁড়াতে বললেন। শর্ত একটাই- সবাইকে বাঘের মতো আক্রমণাত্মক পোজ দিতে হবে। সবাই দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম। পরে দেখলাম ছবিটা ‘অসাম’ হয়েছে। ‘ওয়াও’ হয়েছে।

বাঘের পোজে টিমের সবাই

দার্জিলিং শহর থেকে কিছুটা দক্ষিণে এসে পূব দিকে মোড় নিলো গাড়ি। লামাহাট্টা পৌঁছানোর আগে রাস্তার বাম পাশে দেখলাম ঝাউবন। মেঘগুলো আটকে যাচ্ছিলো পাহাড়ের গায়ে। ঝাউবনের ফাঁক গলে ছবি নিচ্ছিলাম গাড়ি থেকেই। নুরুল আফসার চৌধুরী বলছিলেন, বৃষ্টি না থাকলে এখানে ‘ইয়া’ (ছবি) তোলা কেউ ঠেকাতে পারতো না। সত্যিই তাই!

মাঝে মাঝে বৃষ্টির তোড়ে রাস্তা দেখা যাচ্ছিলো না। দিনের বেলা, অথচ অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিলো চরাচর। দু একটা পাহাড় পেরোতেই দেখছিলাম বৃষ্টি কমছিলো। গাছপালা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলো। দু’পাশে বাড়িঘর নেই। নেই কোনো ইট কাঠের স্থাপনা। কেবলই নানান গাছ-গাছালির শোভা। চা বাগান। ঘাসে ছাওয়া সবুজ চত্বর। গাছপালার মুকুট মাথায় আকাশ ছোঁয়া চূড়া।

বৃষ্টি ছাড়ছিলই না। লামাহাট্টা এসে গেলাম। ঘন্টাখানেক লাগলো। লামাহাট্টার উচ্চতা ৫ হাজার ৭০০ ফুট। প্রায় দার্জিলিংয়ের সমান উচ্চতায়। দার্জিলিং এবং কালিম্পংকে সংযুক্ত করেছে এই এলাকাটি। জানা গেলো, এখানে লোকবসতি খুব কম। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা বলে কথা। স্থানীয় লোকদের সবাই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এখানে কি কৃষি হয় সেটাই বুঝলাম না। তবে হ্যাঁ চা বাগান করাও তো কৃষি কাজের মধ্যে। পাহাড় থেকে ফলমূল সংগ্রহ কিংবা পাহাড়ের গায়ে ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু চাষও কৃষির মধ্যেই পড়ে।

নেপালের খুব প্রভাব স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে। কথা বলেন নেপালি ভাষায়। তাদের পদবীও নেপালিদের মতো। বাস করেন শেরপা, ইয়ালমস, তামাং, ভূটিয়া ও দুপাস সম্প্রদায়ের লোক। সম্ভবত ভারতের বিখ্যাত ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া এই এলাকা থেকেই উঠে এসেছিলেন। তবে শেরপা সম্প্রদায় কেন বিখ্যাত জানেন? পর্বত আরোহণে দক্ষ এঁরা। যারা মাউন্ট এভারেস্ট বা উঁচু পর্বতারোহণ করতে চান- তাদেরকে অবশ্যই শেরপাদের সাহায্য নিতে হয়। সঙ্গে নিতে হয়।

এখানে পাইন গাছের পাশাপাশি ধুপি খুব দেখা যায়। পাইনতো অনেকেই চেনেন। বিশাল লম্বাকৃতির বৃক্ষ। ডালপালা ছড়ায় না। শুধু উপরের দিকে উঠে। কিন্তু ধুপি গাছ কি? এটি দূর থেকে অনেকটা ঝাউ গাছের মতো মনে হয়। আসলে ঝাউ নয়। দূর থেকে কাটা জাতীয় গাছ মনে হলেও আসলে কাটা নেই এর গায়ে। তবে পাতা ও বা ছোট ডাল দেখলে মনে হয় ধারালো। আসলে তা-ও নয়। কাছ থেকে দেখলে মনে হতে পারে পাটের সুতোয় বোনা শতরঞ্জি। সুতোয় বোনা হাতের কাজও মনে হতে পারে। কেটেছেঁটে রাখলে লম্বাটে হয়। আবার ঝোপের মতো হয়; হয় গোলাকারও। ধুপির ফলও হয়। দেখতে অনেকটা হরিতকির মতো। কাচা ফল সবুজ। পাকলে কালো। আফ্রিকান মেয়েদের চুলের বিনুনীর মতোও লাগে। মোদ্দা কথা এটা একটি পাতা বাহার বা শোভা বাহার গাছ।

লামাহাটার সৌন্দর্য

অল্প সময়ের মধ্যে লামাহাটা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। আগে এর নাম খুব একটু শোনা যায়নি। জায়গাটি লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানকার ইকো ট্যুরিজম এর জন্য। পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রেখে; জীব এবং জৈব বৈচিত্র্য অটুট রেখে এখানে ট্যুরিজম স্পট ডেভেলপ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সব হচ্ছে। আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে পরিবেশ। এখানে রাজ্য সরকার এবং গ্রামবাসীদের অংশিদারিত্বে কিছু রোড সাইড গার্ডেন এবং রিসোর্ট পরিচালিত হয়।

এখানকার একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়। রাস্তার পাশে রঙিন কাপড়ের অসংখ্য নিশান। এটা নেপালে দেখেছিলাম। সবচেয়ে বেশি দেখেছিলাম ভুটানে। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এটা করেন। ভুটানে শুনেছিলাম কেউ মারা গেলে বাঁশের আগায় (সাধারণত ১০১ বা ১১১ টি বাঁশ) রঙিন কাপড় বেঁধে দেয়া হয়। বাতাসে চিকন লম্বা কাপড় উড়তে থাকে। আবার ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্যও এটা করা হয়ে থাকে। তবে এখানে কৃপা লাভই মূল উদ্দেশ্য। কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও ছিলো। বলা হয়ে থাকে এইসব রঙিন কাপড়ের (স্থানীয় ভাষায় প্রার্থনা ঝালক) মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, সুন্দর এবং পবিত্র ভাবের উদ্রেক করে। সেতু বা বিভিন্ন স্থাপনার পাশেও এ ধরনের প্রার্থনা পতাকা দেখা গেলো। 

আধুনিক লামাহাটাকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে আরেকটি বিষয়কে সামনে রেখে। একে বলা হচ্ছে রোমান্টিক স্থান। শান্ত পরিবেশের সঙ্গে পাহাড়-নদী দর্শনের সুখ অনাবিল। আর তাই মধুচন্দ্রিমা বা হানিমুনের জন্য এই জায়গাটি বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। শৈল পাহাড়, শিলাখন্ডের ধার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী, ট্রেকিং, ধুপি বন- সবই কেড়ে নেবে মন! একটি তথ্য দিয়ে রাখি। শিলিগুড়ি থেকে লামাহাটার দূরত্ব ৭২ কিলোমিটার। জিপে গেলে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টা। আর দার্জিলিং থেকে? আগেই তো বলেছি, ঘন্টাখানেক।

ত্রিবেণী ভিউ পয়েন্টে লেখক

যাহোক, এবার বলছি আরেকটি রোমান্টিক জায়গার কথা। অন্তত আমার কাছে এটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে রোমান্টিক স্পট মনে হচ্ছিলো। কারণ সেখানে একটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। যার নাম লাভারস মিট ভিউ পয়েন্ট। মূল গেইটের মধ্যে কথাটি লেখা। ধারণাটি চমৎকার! প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে নিজেরা দেখা করবেন এবং ওই ভিউ পয়েন্ট উপভোগ করবেন। জায়গাটির নাম অবশ্যই রোমান্টিক- ত্রিবেণী। সহজ বাংলায় বলা চলে তিন বেণীর সমাহার। এখানে নদীকে বিনুনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ভালোবাসার দুটি মানুষের প্রথম দর্শনের মুহূর্ত প্রতীকি অর্থে মূর্ত হয়ে উঠেছে ত্রিবেণী। লামাহাটা থেকে এটি মাত্র ৪ কিলোমিটার পূব দিকে।

তবে ত্রিবেণী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পং এর মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পং এ প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ জল নিয়ে এসেছে রাঙগিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্র¯্রবণ থেকে রাঙগিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে। সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন; তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল ¯্রােতস্বীনি এখানে করেছে আলিঙ্গন। তারপর জলপরীর মতো বয়ে গেছে হাজারো মাঠ পেরিয়ে।

ওপর থেকে পাখির চোখ করে দেখতে হয় ত্রিবেণীর সৌন্দর্য। ভিউ পয়েন্ট পাশের একটি পাহাড়ের ওপর। খাড়া ঢালুতে কংক্রিটের গাঁথুনি। রেলিং করা। কিছু অংশে ছাউনি আছে। বাকিটা উন্মুক্ত। সেখান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দেখা যাচ্ছিলো মিলনস্থলটি। সব মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অসামান্য জায়গা এই ত্রিবেণী। সেদিন জলটা ঘোলা ছিলো। বৃষ্টির পানি লালচে মাটি চুইয়ে পড়েছিলো নদীতে। তাই জলটা ছিলো ঘোলাটে পিঙ্ক।

ত্রিবেণী ভিউ পয়েন্টে গ্রুপ সেলফি

বৃষ্টিতে ভিজেই এক দৌঁড়ে চলে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। আমি যাওয়ার আগেই ফিরোজ আলম আর মিলটন পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারা যখন গিয়েছিলেন তখন ত্রিবেণীটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছিলো। যেই আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই চারদিক থেকে মেঘ এসে পুরো ভিউটাকে ঢেকে দিলো। কি আর করা। ওর মধ্যেই ছবি তুললাম। বৃষ্টি বাড়লে সবাই ছাউনির নিচে চলে গেলো। ফিরোজ আলম বললেন, দাঁড়ান আপনার প্যানোরমিক ছবি তুলে দিই।

এখানে চা পানের জন্য সবাই বসে। কিন্তু সকাল থেকেই বিরামহীন বৃষ্টি থাকায় দোকানদার চুলোয় চা বসায়নি। আলো কম ছিলো। ওর মধ্যেই গ্রুপ সেলফি হলো। আবার দৌঁড়ে জিপে উঠলাম। উদ্দেশ্য কালিম্পং।



রাইজিংবিডি/২৮ মে ২০১৮/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়