ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

নারীর জৈবিক পরিবর্তন ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ

মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নারীর জৈবিক পরিবর্তন ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ

মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি : ভূমিষ্ঠ পরবর্তী ধাপগুলোতে একজন কন্যাশিশুর ক্রমবিকাশ ও রূপান্তর হয়। বহু ধরণের রূপান্তরের মধ্যে জৈব বিকাশের প্রাধান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্পষ্ট দৃশ্যমান। কেবল কন্যাশিশুর দৈহিক রূপান্তরে বালিকা, কিশোরী, তরুণী ও পরিপূর্ণ নারীর পরিণতিটি তৃপ্তিতে গ্রহণ করেছে পিতৃপ্রধানগণ। তাদের সুবিধা মত মাংস পিণ্ডে গড়া একজন মানুষকে কেবল নারীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চাহিদামত নারীদের বিভিন্ন ভূমিকায় রেখেছে। অনেকটা তরল পদার্থের মতো। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ অব্দি মন্দ-ভালো যে কোনো কিছুতেই নারী তার স্বাতন্ত্র্য ভুলে পুরুষের সত্তার সাথে একাত্ববোধ হয়ে চাহিদার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছে। বহুকাল শিকলবন্দি জীবনের অবসান ঘটিয়ে নারীদের নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা গড়বার লড়াইয়ের পিছনে পুরুষদের কিন্তু অবদান রয়েছে। তাও আবার পুরুষদের প্রয়োজনেই। পুরুষদের খোরাক মেটাতে নারীদের কখনও বা ইতিবাচক কখনও নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। পুরুষদের খোরাকের অন্যতম হলো জৈবিক চাহিদা। এর জন্য পুরুষ নারীকে গ্রহণ করেছে। করেনি কেবল নারীর প্রাকৃতিক পরিবর্তনকে। নারীকে তারা খারাপ/ অসুস্থ/অশুচি বলতে একচুলও ছাড় দেয়নি। শরীর ও মন পরিবর্তনের গঠনক্রিয়া ঋতুক্ষরণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একজন নারীর দেহে এটি ভাঙ্গে ও গড়ে। সন্তান ধারণ ও প্রসব যতটা  যন্ত্রণাময়  তার চেয়েও বিরক্তিকর ঋতুক্ষরণ। কেবল নারীকে শত যন্ত্রণা সহ্য করে মনের সাথে আপোষ করতে হয়েছে। মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে।

হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন: ‘নারীর ভেতর প্রতিমাসে গড়ে ওঠে একটি দোলনা; অপেক্ষা করে একটি শিশুর জন্যে কিন্তু শিশু আসে না বলে ভেঙ্গে যায় দোলনাটি। ওই নষ্ট দোলনা নারীর ভেতর থেকে ক্ষরিত হয় বিষণ্ন রক্তিম ধারারূপে। নারী পুরুষেরই মতই দেহ, তবে এ সময় তার দেহ সে নয়; অন্য কিছু। নারী প্রজাতির শিকার; নারী তার জীবনের অনেকগুলো বছর বিশেষ বিশেষ সময়ে বন্দী থাকে তার অভ্যন্তরীন ঋতুচক্রে।’ (নারী, হুমায়ুন আজাদ)।

এ চরম সত্যকে পিতৃপ্রধানগণ সম্মান, পুরস্কার বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে দিয়েছে শাস্তি। করেনি আশীর্বাদ। করেছে তিরস্কার। এমনটি হবার কথা ছিল না যে, পিতৃজাত ঋতুস্রাবকে দূষণ মনে করবে। ভাববে তারাও দূষিত হচ্ছে। এমনটি হবার ফলে নারীরা বিব্রতবোধ করে। প্রাচীন কালের ঋতুস্রাবের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সমাজে বিলুপ্তপ্রায় এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত। হুমায়ুন আজাদ তার ‘নারী’ গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘কোন কোন সমাজে মেয়ের প্রথম ঋতু দেখার সময় উৎসব করা হতো। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ করে চট্টগ্রামে ঋতুস্রাবকে বলা হতো ‘পুষ্পদেখা’  এবং সেখানে কন্যা বা বধূর প্রথম রজঃস্বলা হলে বাজনা বাজিয়ে এবং সহেলা ও নৃত্যাদির অনুষ্ঠান করে উৎসব করা হতো তবে রজঃস্বলা নারীকে মুসলিম ঘরেও অপবিত্র মনে করা হতো।’

এমনটি হবার ছিল না যে পিতৃতন্ত্রের তিরস্কারের ঋতুস্রাব গোপন নিষিদ্ধে পরিণত হবে। বরং তা প্রকাশ্যে মর্যাদা দেবার কথা ছিল। আদিম মানুষেরা নারীর পুনরাবৃত্তিকে দেখেছে ঘৃণার চোখে। বিভিন্ন ধর্মে নারীর মাসিক চক্রকে অপবিত্র বলা হয়েছে। রক্তক্ষরণ একধরনের শান্তি। সেটার পরিবর্তে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক ধরনের ভয়। তাই সমাজে ঋতুমতী নারীকে নির্দেশ করা হয়েছে অশুচি। এই কুসংস্কার বিশ্বসংসারে বহুল প্রচলিত।  ভারত ও নেপালে এখনও প্রচলিত যে, রজঃস্বলা নারী কোন সবজি, ফল বা খাবার জাতীয় কিছু স্পর্শ করলে সেটি পঁচে যাবে। দুঃখজনক হলে এটিই সত্য বর্তমান বিশ্বের কোন কোন সমাজে রজঃস্বলা নারীকে একঘরে করে রাখা হয়।

ঋতুমতী নারীরা পুরুষের সাথে খোলামেলা আলোচনা থেকে নীরব ও বিরত থাকে শুধুমাত্র লজ্জা, নিষিদ্ধকরণ ও কুসংস্কারে। ছোটবেলার কিছু ঘ্টনা বুঝিয়ে দেয় বর্তমান সমাজে রজঃস্বলা কতটা নিষিদ্ধ। খেলতে গিয়ে হাটু বা রান্নায় হাত পাকাতে গিয়ে আঙুল কেটেছে। লাল রক্ত বের হয়েছে। বাবাকে বলা নিষেধ। প্রথম যেদিন অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে রক্তের সূত্রপাত সেদিন মা-খালাদের বারণ। নিষেধ। তাদের বলতে শোনা যায় শরীর খারাপ হয়েছে, নামায নিষেধ। পুজোর ঘরে প্রবেশ নিষেধ। অপবিত্র। অশুচি। অথচ মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায়- সুস্থ বলেই মাসিক হয়েছে। দূষিত রক্ত বের  হয়েছে। কিন্তু সমাজের চোখে এটাই খারাপ। ফলে ঋতুচক্রের সময় নারীর আপত্তিকর দেহ তাকে মানসিক ও নৈতিকভাবে হীনমণ্যতায় ফেলে।

ঋতুস্রাবের সময় নারী পুরো প্রটেকশনে থাকলে কখনই অশুচি হবার নয় বরং তা হাইজিন ও সায়েন্স। প্রটেকশনে থাকলে রোগ জীবাণু ছড়াবে না এ বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে গিয়েও পদে পদে নারীদের হীণ করেছে। টিভিতে স্যানিটারী ন্যাপকিন বিজ্ঞাপনে নীল তরল পদার্থের যেটা দেখাচ্ছে সেটা নাকি পিরিয়ডস। তাহলে কী রক্তের রং নীল হয়। এতদিন বই পুস্তকে যেটা পঠিত হয়েছে সেটা কী তাহলে ভুল? ধমনীতে কী তাহলে নীল রক্ত দৌড়ায়। কোন মাপের স্যানিটারী পরতে হবে, কোনটার  শোষণ করার ক্ষমতা বেশী, সব বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছে কিন্তু প্যাডের গুণবিচারে এটা নীল তরল। তাহলে কী রক্তের রং লাল দেখালে যৌনতা প্রকাশ পাবে বলে এত  লুকোচুরি। এটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলেও প্রগতিশীল গণমাধ্যমও সেখান থেকে বের হতে পারে নি। প্রাচীন প্রথাকে আঁকড়ে রেখে নারীদের পিছনে রাখার জন্য যারা এসব বিজ্ঞাপন বানায় তারাও কিন্তু সমাজেরই  অংশ।

কেউ নারী হয়ে জন্মায় না বরং ক্রমান্বয়ে নারীতে পরিণিত হয়। পরিণত নারী হওয়ার জন্য সে সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক বিশ্বাসগুলো ধারণ করে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ঋতুমতী নারীর শারিরীক, মানসিক ও আবেগের উপর প্রভাব পড়ে। ফলে নারীরা হীনমন্যতায় ভোগে। এসময় পরিবারের অনুপ্রেরণা না পেয়ে মানসিক স্থায়িত্ব হারানোর আশঙ্কা থাকে। তারা এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে না পারায় অনেকটা অন্তর্মুখী আচরণ করে। তাদের  মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা যায়। কখনই নারীরা ভাবেনি রজচক্র বিষয়ক খোলামেলা আলোচনার অধিকার তাদের রয়েছে। রজচক্র নারী অধিকারের ইস্যু বিধায় এটি নারীবাদ আন্দোলনে দাঁড়ানো উচিৎ। ঋতুস্রাব একজন নারীর সম্মান ও মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার মত অধিকার। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র -১৯৪৮ (৩) অনুযায়ী প্রত্যেকের জীবনে, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার জন্য রজচক্রও অধিকারের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকতে পারত কিন্তু সমাজ সেটিকে অধিকারের পর্যায়ে ফেলে নি।

ঋতুস্রাব বিষয়ক বিভিন্ন প্রথা ও কুসংস্কারে বিশ্বের যে কোন নারী ও কিশোরীরা যৌন নির্যাতান, ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হতে পারে বলে গবেষকদের ধারণা। ভারতে অসাস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনায় নারীরা বন্ধ্যাত্ব ও ক্যানসারসহ এইচআইভি/এইডস ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বলে দেয় একজন ঋতুমতী নারীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের  জন্য ট্যাবুস ভেঙ্গে বেশী বেশী প্রচারণা দরকার।

লেখক: এম.ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়