ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

এখনো স্বপ্ন বেঁচে আছে তার

সাকিবুল কবীর রিটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
এখনো স্বপ্ন বেঁচে আছে তার

মাত্র সাড়ে ৪ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় স্পাইনাল ইনজুরির কারণে গলা থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়। এখনো সেভাবেই বেঁচে আছে জ্যোতি। এখনো স্বপ্ন বেঁচে আছে তার।

জ্যোতি হোসেন নামের সেই মেয়েটি এ বছর এসএসসিতে বিজ্ঞানবিভাগ থেকে ৯৯২ নম্বর পেয়ে (জিপিএ-৫) উত্তীর্ণ হয়েছে।

পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় তার স্বপ্নের কথা জিজ্ঞাসা করলে মেধাবী এই শিক্ষার্থী জানান, তিনি আবহাওয়াবিদ হতে চান। শারীরিকভাবে অক্ষম তাই ভাষা আর বুদ্ধি দিয়ে যা করা যাবে, ভবিষ্যতে সেটিই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান।

জ্যোতি হুইল চেয়ারে সার্বক্ষণিক তার মায়ের সহযোগিতায় চলাচল করেন। ছোটবেলায় মায়ের সাথে নানাবাড়ি থেকে ফেরার পথে ভ্যান থেকে পড়ে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। এরপর থেকে স্পাইনাল ইনজুরির কারণে তিনি চলাচলের শক্তি হারান।

জ্যোতি যশোরের ঝিকরগাছা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পারবাজার কমিশনারপাড়ার বাসিন্দা মালয়েশিয়া প্রবাসী কাদের হোসেন ও রেকসোনা হোসেনের মেয়ে। চলতি বছর ঝিকরগাছা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

মা রেকসোনা জানান, তার দুই মেয়ের মধ্যে জ্যোতি বড়। ছোট মেয়ে জেবা এবার নবম শ্রেণিতে।

তিনি জানান, ‌২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে নার্সারিতে পড়ার সময় দুর্ঘটনায় জ্যোতির পুরো শরীর অকেজো হয়ে পড়ে। হুইলচেয়ারে শুরু হয় পথচলা। ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত বাম হাত দিয়ে লেখালেখি করতে থাকে। চিকিৎসার একপর্যায়ে ডান হাতে লিখতো। বাড়ির পাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষকদের অসহযোগিতায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হতে হয়।

হার না মানা জ্যোতি বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে ঝিকরগাছা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। মা তাকে প্রতিদিন হুইলচেয়ারে করে স্কুলে আনা নেওয়া করতে থাকেন। মায়ের কঠোর পরিশ্রমে জ্যোতি লেখাপড়া চালিয়ে যায়। কিন্তু ডান হাতে দ্রুত লেখা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রতিদিন ৮/১০ ঘণ্টা পড়াশুনা করলেও দুঃচিন্তা, দ্রুত লিখতে না পারলে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল সম্ভব নয়। পরীক্ষার আগে প্রতিবেশী আরেক শারীরিক প্রতিবন্ধী মিষ্টি পরামর্শ দেন তার জন্যে একজন শ্রুতিলেখক নিতে। এরপর স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন মুকুল যশোর বোর্ডে যোগাযোগ করে জ্যোতির ছোটবোন জেবাকে শ্রুতি লেখক হিসেবে মনোনীত করাতে সক্ষম হন।

ঝিকরগাছা এমএল পাইলট সরকারি বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি কক্ষে শ্রুতি লেখক নিয়ে সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

মা রেকসোনা বলেন, ‘মেয়েটি খুবই মেধাবী। তার খাওয়া-দাওয়া, চলাচল সবকিছুই আমাকে করতে হয়। ঢাকায় সিআরপিতে নিয়ে গেছি। তারা বছরে দুইবার তাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। ডাক্তাররা আশ্বস্ত করেছেন, ঠিকমত চিকিৎসা- থেরাপি চললে একসময় সে নিজেই হাঁটাচলা করতে পারবে।'

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় গেলে প্রতিবার কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা খরচ। তার বাবা আর দুই বছর পর দেশে ফিরবেন। আমাদের সহায় সম্পত্তি তেমন নেই। চিকিৎসা আর উচ্চশিক্ষার জন্যে এখন বেশ টাকা পয়সার প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোনও সহযোগিতা পাওয়া যায়, তবে মেয়েটি আরো ভাল করবে।'

তিনি বলেন, ‘সরকার প্রাইমারি আর হাইস্কুলে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের উপযোগী সিঁড়ির ব্যবস্থা করেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি চাকরির জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও একই ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।'

ঝিকরগাছা পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুল আমিন মুকুল বলেন, ‘জ্যোতি খুবই মেধাবী মেয়ে। স্কুলজীবনে তার কাছ থেকে কোনোপ্রকার অর্থ নেওয়া হয়নি। নিয়মিত তার বাসায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। তার জন্যে দোতলা বাদ দিয়ে নিচতলায় ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে বসতে পারতো না। তার জন্যে আলাদা টেবিলও তৈরি করে দেওয়া হয়। সুযোগ পেলে সে অনেকদূর যেতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।'

জ্যোতি বলেন, ‌‘এ সাফল্য আমার মা, বোন, শিক্ষকমন্ডলীর। তাদের কাছে আমি চিরঋণী। ভাল করে লেখাপড়া শিখতে চাই, যেন কারোর উপর বোঝা না হতে হয়।

ভবিষ্যত স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে জ্যোতি বলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছে- আবহাওয়াবিদ হওয়ার। তা না হলে আইনজীবী। শারীরিকভাবে অক্ষম তাই ভাষা আর বুদ্ধি দিয়ে যা করা যাবে, ভবিষ্যতে সেটিই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাই।'

 

যশোর/রিটন/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়