ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ব্যথা পেলে বাবা?

মুশফিকুর রহমান বাদল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ব্যথা পেলে বাবা?

|| মুশফিকুর রহমান বাদল ||

গর্ভধারিণী-জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সবার জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে৷ তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়তো তেমন প্রয়োজন নেই৷ তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘মা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। বছরের আর ১০টা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মায়ের খোঁজখবর নেন, তাঁকে উপহার দেন৷ যদিও গর্ভধারিণী মা সন্তানের মুখে শুধু ‘মা' ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান৷

‘মা' ছোট্ট একটা শব্দ হলেও তার পরিধি বিশাল। সৃষ্টির শুরু থেকেই মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার৷ মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণিরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়৷ আমাদের ধর্মে আছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত্‌। উপনিষদে আছে, মাতৃ দেব ভবঃ৷ অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিণী, জীবন্ত ঈশ্বরী৷ তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদ্যাশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় আমরা যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের কিন্তু আমরা মাতৃরূপেই চিনেছি৷ খ্রিষ্টধর্মেও আছে মা মেরি’র বিশেষ তাৎপর্য৷ তাই কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন- তিনি গৃহিণী হোন বা চাকরিজীবী হোন, বৃদ্ধা বা জান্নাতবাসী হোন এবং যত কুশ্রীই হোন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি দেবীস্বরূপ। সেই গর্ভধারিণী মায়ের জন্য কিনা বছরে শুধু একটা মাত্র দিন! তবে এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করাও ঠিক নয়৷ অন্তত এ উসিলায় একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী৷

সব মা-ই তাঁর সন্তানের বেঁচে থাকার জন্য, মঙ্গল কামনার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেন- এ চিরন্তন সত্যটি শুধু মানুষের মাঝেই নয়, প্রকৃতির অন্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও সত্যি। তেমনই এক প্রাণির নাম মাকড়সা। মাকড়সার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মা মাকড়সা সেই ডিম নিজের শরীরে বহন করে বাচ্চা না ফোটা পর্যন্ত। যখন বাচ্চা হয় তখন মা মাকড়সা বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের শরীর বিলিয়ে দেয় তাদের খাবারের জন্য। বাচ্চা মাকড়সারা মা মাকড়সার দেহ খেতে শুরু করে ঠুকরে ঠুকরে। সন্তানের জন্য মা নীরবে হজম করে সব কষ্ট-যন্ত্রণা। এমনি করে এক সময় মায়ের পুরো দেহ চলে যায় সন্তানের পেটে। মাকড়সা মায়ের সন্তানের জন্য এ আত্মত্যাগের কারণেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে মাকড়সার স্থান অনেক ওপরে।

‘মা’ শব্দটার মাঝে এক অসাধারণ মধুময়তা আছে। হৃদয়ের গহীন অরণ্য থেকে মা শব্দটা যেন কোনো এক বুনো ফুলের সৌরভ ছড়ায় মনে-প্রাণে আর অস্তিত্বে। মা শব্দটা মনে শক্তি জাগায়। তাই অবুঝ শিশু ভয় পেলে ‘মা’ বলে ডাকে। চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত কোনো যোদ্ধাও তার শেষ মুহূর্তের লড়াইয়ের শক্তি খুঁজে পায় তার মায়ের মুখটি স্মরণ করে। ফাঁসির আসামিও বোধকরি তার শেষ সময়ে জীবনের নানা স্মৃতির সঙ্গে স্মরণ করে তার মায়ের মুখ।

মাকে হারিয়েছি বছর চার হলো। মায়ের অভাব এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই জয়জয়কারে এখন অনেকেই তার প্রিয় মাকে নিয়ে অনেক কিছুই লিখে থাকেন। সেসব মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ি আর মায়ের মুখ কল্পনা করি। সব সময় প্রার্থনা করি মা যেন জান্নাতে শান্তিতে থাকেন। মাকে নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। লেখা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া লিখিনি তার কারণ নিজের ওপর আস্থা ছিল না বলে।  দুর্বল লেখনীর কারণে যদি আমার মা আবার ছোট হয়ে যান! এখনো মাকে নিয়ে লেখার সাহস পাই না। মা নিয়ে বরং গোপনে ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। চোখে ভাসে সব সময় মায়ের মুখ।

এর চেয়ে বরং দুটি শোনা ঘটনা বলেই লেখা শেষ করছি। ঘটনাটি কিছুদিন আগে মসজিদের ইমামের মুখ থেকে শোনা। তিনি তার বয়ানে বলেন, ‘হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে জানতে চান বেহেশতে তাঁর সঙ্গী কে হবেন?’ জবাবে মহান রাব্বুল আলামিন জানান, ‘কোনো এক কসাই, যে কিনা তার মায়ের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছে।’ হযরত মুসা (আ.) খুঁজতে লাগলেন সেই কসাইকে। পেয়েও গেলেন এক সময়। তারপর তার কাছে গিয়ে বললেন, ‘শোন কসাই, আজ আমি তোমার মেহমান হবো।’ কসাই তাঁকে আগে কখনো দেখেননি, চেনেনও না। তারপরও খুশি মনে তাঁকে নিয়ে বাড়ি গেলেন। মুসা (আ.) খেয়াল করছিলেন কসাইয়ের এমন কী গুণ আছে যে কিনা তার বেহেশতে সাথী হবে! তিনি খেয়াল করলেন, কসাই ঘরে ঢুকেই দোলনা জাতীয় কিছু থেকে একজন জবুথবু বৃদ্ধাকে নামিয়ে গোসল করিয়ে খাইয়ে আবার দোলনায় রেখে দিলেন। মুসা (আ.) তখন কসাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই বৃদ্ধা কে, যাকে এমন যত্নআত্তি করলে? কসাই বললেন, উনি তার গর্ভধারিণী মা। মুসা (আ.) তখনই বিষয়টা বুঝতে পেরে আল্লাহকে বললেন, ‘হে আমার সৃষ্টিকর্তা, আমি বুঝতে পেরেছি কেন ওই কসাই আমার বেহেশতের সঙ্গী হবে।’

ইমাম সাহেব এই ঘটনা বলে উপসংহারে বললেন, সুযোগ থাকতেও যেসব সন্তান তার বাবা-মাকে সেবা করল না বা তার জান্নাতবাসী মা-বাবার জন্য দোয়া করল না, তাদের কোনো এবাদত কখনো কবুল হবে না। তাদের জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ।

অন্য গল্পটা আজ থেকে তিন দশক আগে বাজারে এক ওষুধ বিক্রেতার কাছ থেকে শোনা, যা আমার কিশোর প্রাণকে আবেগতাড়িত করেছিল। গল্পটা আজও আমার কানে বাজে। এখনও আবেগাপ্লুত করে। গ্রামের এক তেজস্বী যুবক। নিজেকে আরো শৌর্য-বীর্যে অধিকারী করতে গেলো এক ধ্যানী মুনীর কাছে। মুনীকে সে তার মনের গোপন বাসনার কথা জানাল। মুনী অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, ‘তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে যদি তুমি একটি কঠিন কাজ করে আমাকে দেখাতে পারো।’

যুবক বলল, ‘ধর্মাবতার, পৃথিবীতে কোনো কাজই আমার কাছে কঠিন নয়। বলুন কী করতে হবে।’ মুনী তাকে বললেন, ‘যদি তুমি আজ সূর্য ডোবার আগেই তোমার গর্ভধারিণী মায়ের কলিজাখানা এনে আমাকে দেখাতে পারো তাহলে তোমার সকল মনোবাসনা পূরণ হয়ে যাবে।’

কথাটা শোনামাত্র যুবক বাড়ির পানে দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি গিয়ে দেখে তার মা ঘুমিয়ে আছেন। সে ভাবল এইতো সুযোগ। সঙ্গে সঙ্গে সে মায়ের বুকের ওপর চড়ে এক কোপে বুক ফেড়ে কলিজা বের করে আবার দৌড়াতে শুরু করল মুনীর উদ্দেশে।

সূর্য ডুবতে আর বেশি সময় বাকি নেই। তাই আরো জোরে আরো জোরে দৌড়াতে শুরু করল সেই যুবক। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ এক উঁচু ঢিবির সাথে বাধা পেয়ে সে সশব্দে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত থেকে ছিটকে গেল মায়ের কলিজাখানি। যুবক ব্যথায় কোঁকাচ্ছে আর ওঠার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। হঠাৎ তখন সে শুনতে পেল, তার মা যেন বলছে, ‘ব্যথা পেলি বাবা।’

সেই তেজস্বী যুবক খাঁ খাঁ প্রান্তরে মায়ের কণ্ঠ শুনে চমকে গেল। ভয়ও পেল। তাকিয়ে দেখে, তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া কলিজা থেকেই কণ্ঠটা ভেসে আসছে। সে তার নিজের হাতে কাটা কলিজা জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।

গল্পটা এ পর্যন্তই। উপসংহার নেই। তবে এটা বলা যায়, পৃথিবীতে সর্বদা কুসন্তানের কথা শোনা গেলেও কুমাতার কথা কখনো শোনা যায়নি। মা দিবসে সকল মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা।

পুনশ্চ: আজকাল অনেক ছেলেমেয়ে তাদের মা-বাবার ত্যাগ ভুলে যায়। অনেক ছেলেমেয়েকে মা-বাবাকে অযত্ন করতে, অবহেলা করতে দেখা যায়। যাঁদের রক্ত-মাংসে বেড়ে ওঠা সন্তান, যারা আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাঁদেরই হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা সব ভুলে বাবা-মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে৷ এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে। এসব কুসন্তান যদি অন্তত মা দিবসে মাকে নিয়ে একটু ভাবত...। আসলে মা-ই একের ভেতর সব। মা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থাপক, অর্থনীতিবিদ, সুপারভাইজার, সমন্বয়ক, কারিগর, মনিটর, সেবিকা, শিক্ষক- মায়ের উপরে কিছুই নেই।

 

সবশেষে বলি, তাকেই ভালোবাস, যাঁর কারণে এই সুন্দর পৃথিবী দেখেছো; ভালোবাস তাকে, যিনি তোমাকে ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে রেখেছেন; ভালোবাস তাকেই, যাঁর পায়ের নিচে তোমার জান্নাত রয়েছে- আর তিনি হলেন আমাদের গর্ভধারিণী মা।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়