ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমরা গায়ের জোরে সিনেমা নির্মাণ করছি : তৌকীর

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫১, ১৮ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমরা গায়ের জোরে সিনেমা নির্মাণ করছি : তৌকীর

তৌকীর আহমেদ

আমিনুল ইসলাম শান্ত : অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক তৌকীর আহমেদ। মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ে হাতেখড়ি। আশির দশকের শেষের দিকে টেলিভিশন নাটকে পা রেখে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। ছোট পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি বড় পর্দায় অভিনয় করেও দর্শকের হৃদয় হরণ করেছেন এই অভিনেতা। পরিচালক হিসেবেও তিনি সফল। নির্মাণ করেছেন দর্শকপ্রিয় নাটক, টেলিফিল্ম ও চলচ্চিত্র। তবে বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সম্প্রতি রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তৌকীর আহমেদ। এ আলাপচারিতার অংশ বিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।   

রাইজিংবিডি : আশির দশক থেকে টিভি নাটকে অভিনয় করছেন। শূন্য দশক পর্যন্ত টিভি নাটক নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
তৌকীর আহমেদ :
আশির দশকের শেষের দিকে টিভি নাটকে কাজ শুরু করি। অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে আমার অভিনীত প্রথম নাটক ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ বিটিভিতে প্রচারিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১২ বছরের একটি পরিক্রমা। ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’, ‘যত দূরে যাই’, ‘স্বর্ণ কমল’সহ বেশ কিছু এক ঘণ্টার নাটক তখন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তারপর ধারাবাহিক ‘রূপনগর’ নাটকটি দেশব্যাপী আমাকে পরিচিতি ও ভালোবাসা দিয়েছিল। সব কিছু মিলিয়ে আশির দশকে টিভি নাটকে সুযোগ সম্ভাবনা দুটোই তৈরি হয়। তারপর নতুন নতুন পরিচালক, বেসরকারি টেলিভিশন আসতে থাকল। সেই সময়টা একটা কাঁপানো সময় ছিল। আমরাও ওই সময়ের কাজগুলো খুব উপভোগ করেছি। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজগুলো করার চেষ্টা করেছি। তার ফলও পেয়েছি। অন্যদিকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ছিল, তখন আকাশ সংস্কৃতি এতটা উন্মুক্ত হয়নি। যার কারণে এ দেশের মানুষের কাছে টেলিভিশন ছিল প্রধান গণমাধ্যম এবং বিনোদন মাধ্যম। সুতরাং সেই জায়গাটাতে আমাদের দায়িত্বও ছিল অনেক বেশি। আমার মনে হয়, মানুষ তখন তৃপ্তও হয়েছিল। ফলে তারা বিটিভির নাটকগুলো ভালোবেসেছিল। এটাকে স্বর্ণ যুগ মনে করি। আমাদের আগেও ভালো নাটক ছিল। আমাদের পূর্বসূরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফেরদৌসী মজুমদার থেকে শুরু করে সৈয়দ আলী আহসান সিডনি, হুমায়ুন ফরীদি, আফজাল হোসেন, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মুস্তাফাসহ অনেকেই ছিলেন। যারা টিভি নাটককে একটি স্ট্যান্ডার্ডে দাঁড় করিয়েছিলেন। আমি মনে করি, আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত সেই স্ট্যান্ডার্ড ধরে রেখেছিল।

রাইজিংবিডি : বর্তমান সময়ের টেলিভিশন নাটকের মান কী কমে গেছে?
তৌকীর আহমেদ :
টেলিভিশন নাটকের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। টিভি চ্যানেল বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে নাটকের উপর ভীষণভাবে চ্যানেলগুলো নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অন্য যেকোনো সৃজনশীল টেলিভিশন অনুষ্ঠান কমে গেছে। সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে গুণগত মান অনেক সময় রক্ষা করা যায় না- এটা তো আমরা সবাই জানি। যেহেতু অনেক বেশি টিভি চ্যানেল হয়ে গেছে, অনেক বেশিসংখ্যক নাটক নির্মিত হচ্ছে সুতরাং কোয়ালিটি কন্ট্রোলে একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ভালো নাটকও নির্মিত হচ্ছে তার মধ্যে খারাপ মানের নাটকও প্রচুর নির্মিত হচ্ছে। রুচির দৈন্য তৈরি হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে শুধু সস্তা খোরাক মেটানোর জন্য নাটক নির্মাণ করছেন নির্মাতারা। তবে এর মধ্যে ভালো মানের নাটকও আছে কিন্তু সেগুলো এত ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

রাইজিংবিডি : বর্তমানে প্রচুর নাটক নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু ‘অয়োময়’, ‘রূপনগর’-এর মতো কয়টা নাটক এখন দর্শক হৃদয়ে সেভাবে গেঁথে থাকছে?
তৌকীর আহমেদ :
এ প্রশ্নের উত্তর তো আপনারাই দিবেন। আমার দেয়া ঠিক হবে না। তবে মনে গেঁথে থাকছে না। তার বড় কারণ হচ্ছে, চ্যানেলগুলো দর্শক হারিয়েছে। আশি-নব্বই দশকে একটি নাটক প্রচারিত হলে তা লক্ষ-কোটি মানুষ দেখত। আর এখন ক্রমাগত বিজ্ঞাপনের চাপ, প্রচার নীতিমালা না থাকা, বিজ্ঞাপন নীতিমালা না থাকার কারণে এক প্রকার দর্শক বিতারণ চলছে। সত্যি কথা বলতে কি এখন মানুষের কাছে অনেক বেশি অপশন রয়েছে। একজন দর্শক চাইলেই বিদেশি যেকোনো চ্যানেল দেখতে পারেন। তখন আমরা সপ্তাহে একদিন ইংলিশ লীগের একটি খেলা দেখতে পারতাম। কিন্তু এখন মানুষ সব দেখতে পারছে। সেই সঙ্গে আমাদের নাটকের মান খারাপ হওয়ার কারণে দর্শক এখান থেকে সরে গেছে। যার কারণে একজন অভিনেতা অনেক বেশি নাটকে অভিনয় করেও অনেক পরিচিতি পাচ্ছে না। একজন নির্মাতাও অনেক বেশি নাটক নির্মাণ করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। আমার মনে হয়, এটা আমাদের পলিসিগত একটি সমস্যা। এতগুলো টিভি চ্যানেল কি আমাদের দরকার ছিল? আর যেহেতু চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, তবে তার মান নিয়ন্ত্রণ কে বা কারা করবেন? কিংবা এসব চ্যানেল পরিচালনার জন্য দক্ষ কলাকুশলী বা শিল্পী আছে কিনা তার বিচার করাও দরকার ছিল।

রাইজিংবিডি : আপনি ও বিপাশা হায়াত জুটি বেঁধে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে তেমন কোনো জুটি চোখে পড়ে না। তবে কি নতুন কোনো জুটি তৈরি হচ্ছে না?
তৌকীর :
এ বিষয়ে আমি কথা বললে সেটা ভালো শোনাবে না। তবে জুটি কোনো অপরিহার্য বিষয় না। জুটি তো দর্শকের চাওয়া থেকে তৈরি হয়ে যায়। যখন দর্শক একটি জুটিকে পছন্দ করেন তখন তাদের দর্শক চাহিদা তৈরি হয়।

রাইজিংবিডি : কিন্তু এখনো তো অনেক অভিনয়শিল্পী জুটি বেঁধে অভিনয় করছেন। দর্শক একদম তাদের অভিনয় দেখছেন না তা তো নয়।
তৌকীর :
এ ক্ষেত্রে আসলে দর্শক দেখছেন কম। আর যারা দেখছেন তাদের মান নিয়েও চিন্তা করতে হবে। যখন একটি জুটির নিম্নগামীতা দেখবেন তখন ভাবতে হবে তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থান ভয়াবহ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানে এতটা আশা করা যাবে না। সস্তা জনপ্রিয়তার বিষয় সব যুগেই ছিল কিন্তু সেটা যেন ভয়াবহ আকার ধারণ না করে সে দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার ছিল। কিন্তু জাতীয়ভাবে সেটা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। 

রাইজিংবিডি : এভাবে যদি চলতে থাকে তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম..
তৌকীর :
হ্যাঁ, সবার সামনেই এটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। ‘কেউ’ বলতে যারা এসবের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদেরকে ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা চ্যানেলগুলোর কথা বলছি। নাটক-টেলিফিল্মকে সবাই শুধু বাণিজ্য হিসেবে দেখছে। চ্যানেলগুলো বাণিজ্য মনে করছে, এজেন্সি এটাকে বাণিজ্য মনে করছে কিন্তু কেউ মনে করছে না এটা একটি শৈল্পিক মাধ্যম। যার মাধ্যমে জাতীয় মানুষ গঠন করা যায়, মানুষের রুচির উন্নয়ন করা যায়। কিন্তু সেভাবে তো কেউ ভাবছে না। সবাই এই মাধ্যমটা বাণিজ্য মনে করছে আর এজন্য কেউ এ বিষয়ে ভাবছে না!

রাইজিংবিডি : বর্তমানে ভালো মানের একটি নাটক-টেলিফিল্ম নির্মাণে প্রধান অন্তরায় কী?
তৌকীর :
এক্ষেত্রে বাজেট একটি বড় সমস্যা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, কাজটি পাওয়ার প্রক্রিয়া। একজন ভালো নির্মাতাকে তো কাজটি পেতে হবে। তারপর তাকে সঠিক বাজেটটি পেতে হবে। না হলে ভালো নাটক-টেলিফিল্ম কীভাবে নির্মিত হবে! আসলে একটির সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ বাজেট যদি সঠিক পরিমাণে না পাওয়া যায় তখন কম খরচে যেভাবে বানানো যায় একজন নির্মাতা তখন সেভাবেই নির্মাণ কাজ শেষ করেন।

রাইজিংবিডি : ‘জয়যাত্রা’ থেকে ‘হালদা’। অর্থাৎ আপনার নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
তৌকীর :
২০০৪ সালে ‘জয়যাত্রা’ সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলাম। এটি প্রযোজনাও আমি করেছিলাম। এই সিনেমাটিতে আমার অনেক আবেগ জড়িয়ে ছিল। ভালোবাসা দিয়ে এটা আমি নির্মাণ করেছিলাম। ‘জয়যাত্রা’ বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। পরবর্তী সময়ে যখন আমি অন্য প্রযোজকের সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হলাম, তখন দেখলাম কম বাজেট, কম সময়ে সিনেমা নির্মাণ করা কঠিন কাজ। যার জন্য ‘রূপকথার গল্প’ ও ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নির্মাণের পর আমি বিরতি নিই। কারণ ওভাবে কাজ করা কঠিন ছিল। তা ছাড়া প্রযোজক পেতেও সমস্যা হচ্ছিল। তখন ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমারও পরিকল্পনা করছিলাম। যাই হোক, ‘অজ্ঞাতনামা’ সিনেমার মাধ্যমে আবার ফিরি। তারপর ‘হালদা’, ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নির্মাণ করি। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছি, ভালো কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখি কোথাও পৌঁছানো যায় কিনা। বাংলা চলচ্চিত্রকে যদি সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। কারণ এটি আমাদের জাতীয় পরিচয় বহন করে। একটি সিনেমা নিয়ে যখন ইরান, তেহরান, কসবো বা যুক্তরাষ্ট্রে যাই তখন আসলে সিনেমাটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। সেই জায়গা থেকে কাজটি যদি ভালোভাবে করা যেত তবে এই মাধ্যমেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা সম্ভব।

রাইজিংবিডি : তবে কী সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা পাচ্ছেন?
তৌকীর :
বাঁধা তো অনেক। আগে রুচির বৈকল্যের কথা বলেছি। নাচ-গানের একটি সিনেমা যেভাবে বিপণন করা হয়, একটি ‘স্বাধীন’ সিনেমার ক্ষেত্রে সেভাবে বিপণন বা অন্যভাবে সহযোগিতা করা হয় না। কেননা মানুষও সেভাবে এসব (স্বাধীন) সিনেমায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। আমরা এখন যেসব সিনেমা নির্মাণ করছি সেটা তো গায়ের জোরে নির্মাণ করছি। সিনেমা বানাতে চাই বলে করতে পারছি।

রাইজিংবিডি : ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমা বর্তমানে কোন পর্যায়ে রয়েছে?
তৌকীর :
‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমাটির শুটিং শেষ করেছি। সম্পাদনার কাজও শেষ। ডাবিং কিছু কিছু চলছে। বাকিটা ঈদের পরে হবে। তারপর মিউজিক, কম্পিউটার গ্রাফিক্সসহ বাকি কাজ করব। আর চলতি বছরই সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।   

রাইজিংবিডি : বাণিজ্যিক ঘরানার অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসায়ীকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
তৌকীর :
দেখুন, আমি বাণিজ্যিক ধারার পরিচালক না। এটা এই ধারার নির্মাতারাই ভালো বলতে পারবেন। বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা নির্মাণ আমার জন্য না। এই ধারার সিনেমা নির্মাণ ও অভিনয় কোনোটাই আমি করিনি।

রাইজিংবিডি : বর্তমানে আপনি অভিনয় না নির্মাণ কোন মাধ্যমে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?
তৌকীর :
আমি দুটো মাধ্যমেই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। যখন যেটা করতে বলা হয় সেটাই করি।

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।
তৌকীর :
আমার ইচ্ছে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা। ভালো সিনেমা নির্মাণ করে যেতে চাই। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৮/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়