ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে বর্ষা

বরুণ দাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১০, ১৯ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে বর্ষা

বরুণ দাস: হুমায়ূন আহমেদ একাধারে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, নির্মাতা ও চলচ্চিত্রকার। তিনি মূলত স্বশিক্ষিত চলচ্চিত্রকার। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোকে বলা যায় তাঁরই রচিত সাহিত্যের সম্প্রসারণ। একথা ঠিক যে, তিনি সেলুলয়েডে গল্প বলার জন্যই এই জগতে আসেন। এ প্রসঙ্গে একটি আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘মানুষের তো অনেক রকম ইচ্ছে হয়। যেমন কোনো বই পড়তে পড়তে ভালো লেগে গেলে বইয়ের ঘটনাগুলো দৃশ্য হয়ে চোখের সামনে ভাসে। আমার লেখা অনেক উপন্যাসের কাহিনিচিত্র ঠিক তেমনি আমি দেখতে পাই। একদিন মনে হলো এই একা একা দেখাটা ঠিক হচ্ছে না। অন্যদের দেখানো দরকার। আর এটি সম্ভব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তাই আমার লেখা প্রিয় কয়েকটা উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করবো বলে ঠিক করি।’

বাঙালি জীবন ও মননে বর্ষার প্রবল প্রভাব রয়েছে সেটা বলাবাহুল্য। হুমায়ূন আহমেদের মনের আয়নাতেও বর্ষা তথা বৃষ্টির প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে এক আলাপচারিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘বৃষ্টির ব্যাপারটা ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করা শুরু। থাকতাম সিলেট। প্রচুর বৃষ্টি হতো। বৃষ্টি হলেই ছুটে বাইরে চলে যেতাম। বৃষ্টির মধ্যেই ঝাঁপাঝাঁপি করা, দৌড়াদৌড়ি করা। মা ডাকলেও ফিরে তাকাতাম না। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে কেউ বাস করবে আর বৃষ্টি দেখে পাগল হবে না তা হতে পারে না।’

হুমায়ূন আহমেদ রচিত একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসে বৃষ্টি ও বর্ষার নান্দনিক বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। জীবদ্দশায় তিনি ৮টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। সেখানে বৃষ্টির একাধিক দৃশ্য রয়েছে। তিনি প্রতীকী অর্থে বর্ষাকে ব্যবহার করেছেন চলচ্চিত্রে। বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র পরিচালক যাঁর নির্মিত প্রতিটি চলচ্চিত্রেই রয়েছে বৃষ্টির উপস্থিতি।

‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্রে বৃষ্টির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে রবীন্দ্রসংগীত। এখানে ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে’ এই গানটির সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ জীবনের বৃহত্তর ব্যঞ্জনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন, জীবনের যে স্বাভাবিক প্রবহমানতা সেটি নির্দেশ করেছেন। গানটির সঙ্গে বিভিন্ন দৃশ্যায়নে দেখা যায় বৃষ্টির প্রবল বর্ষণ, প্রচণ্ড বাতাসে গাছের শাখা-প্রশাখার নড়াচড়া, পিচঢালা পথে বদিউল আলমের এগিয়ে আসা, বাড়ির উঠোনে রাত্রি-অপলাদের আনন্দচিত্তে ভেজা, মিলিটারি জিপে পাকিস্তানি এক সদস্যের সিগারেট খাওয়া, রক্তাক্ত লাশ এবং মৃত কুকুরের ওপর বৃষ্টির পানি ঝরা। আবার এমনও হতে পারে বর্ষণমুখর দিনে রাত্রি-অপলার উচ্ছল আনন্দের পাশাপাশি পাকসেনা, রক্তাক্ত লাশ- এসবের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার বদির মর্মান্তিক পরিণতির কোনো একটি পূর্বাভাস তুলে ধরতে চেয়েছেন। কারণ বৃষ্টির মধ্যেই লুকিয়ে আছে আনন্দ আর বেদনার দ্বৈত অনুভূতি।

তবে এই চলচ্চিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দৃশ্য হচ্ছে কাকডাকা বৃষ্টি ভেজা দিনে কবর খনন। যখন পাকবাহিনী একটি গর্তের ভেতর কয়েকজন বাঙালির রক্তাক্ত মরদেহ অবহেলায় মাটি চাপা দিয়ে চলে যায় তখনও আকাশজুড়ে বৃষ্টি নামে। এসময় গোরখোদকরা নীরবে কাঁদতে থাকে। কান্নাজড়িত অবস্থায় তারা মোনাজাত করে। বৃষ্টির জলে কচুপাতা অবনত হয়। এখানে হুমায়ূন আহমেদ রূপাশ্রয়ী প্রতীকের মাধ্যমে মানবমনের অনন্য সম্পর্কগুলো সমন্বিত করার চেষ্টার পাশাপাশি বৃষ্টিকে করুণ রস সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছেন।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে বৃষ্টির যে সিকোয়েন্স রয়েছে, তাতে আনন্দ ও বেদনার দ্বৈত অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যায়। যখন শাহানার নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে তাদের বাড়ি গিয়ে ইরতাজউদ্দিন কর্তৃক অপমানিত হয়ে ফিরে আসে মতি, পরাণ ঢুলির বাড়িতে- ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/ বন্ধুয়ারে, করো তোমার মনে যাহা লয়...’ এই গানের মাঝে সে সান্ত্বনা খোঁজে। আর তখনই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। মতির গান শুনে হাসির ছটায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে আসে কুসুম। এদিকে ইরতাজউদ্দিনের অট্টালিকার দোতলার ঘরের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ছোঁয় শাহানা। মুখে তার আনন্দছটা। গান গেয়ে চলেছে মতি। সে কাঁদছে। বাইরে খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এবার কুসুমকেও কাঁদতে দেখা যায়। বৃষ্টির জলের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তার চোখের জল। বৃষ্টি যেমন আনন্দের, বৃষ্টি তেমনই বেদনার- এই বিষয়টি এখানে গভীরভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্রে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির জল পড়ছে। অন্ধকার রাতে অল্প আলো। ছাতা মাথায় শাড়ি পরিহিতা শাওনকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। আর দোলনাতে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে রিয়াজ। এ দৃশ্যে রিয়াজ শাওনকে বলে, ‘বৃষ্টির গান শুনছি। মানুষ মাঝে মাঝে গান করে কিন্তু প্রকৃতি সারাক্ষণ গান করে।’ এ দৃশ্যে রিয়াজ প্রথমে শাওনকে বৃষ্টিতে ভেজার আহ্বান জানায়। শুরুতে প্রত্যাখ্যান করলেও কিছুক্ষণ পর ছাতা উড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির কাছে নিজেকে সঁপে দেয় তরু চরিত্রে রূপদানকারী শাওন। তার ভেতর দ্বন্দ্বমুখর যে বেদনা সৃষ্টি হয়েছে বৃষ্টির মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সিনেমার আরেক দৃশ্যে শাওনকে ঘরে বসে গান গাইতে দেখা যায়। আর বাইরে অঝোরে কচুপাতায় বৃষ্টির জল পড়তে থাকে। এমনিভাবে ‘বর্ষার প্রথম দিনে, ঘনকালো মেঘ দেখে’ এই গানের সিকোয়েন্সেও তরু ও শফিকের উচ্ছল আনন্দের মাঝে বর্ষার প্রকৃতি ও বৃষ্টি মূর্ত হয়ে ওঠে।

 

‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রে বৃষ্টির বেশ কয়েকটি চমৎকার প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আমিন বসে আছে ছাদে। সরকার সাহেব রেকর্ডে গান শোনেন- ‘কত না ঢঙ্গে কত না রঙ্গে...।’ বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে নাচে জইতরি। সরকার সাহেব জলতরঙ্গ বাজান। মেয়ের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজে জইতরির মা। সরকারের আদেশে চন্দ্রকে চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করার পর আমিন নিজের ঘরে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ঠিক এমন সময় আমিনের সঙ্গে একাত্ম হতে আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। এই বৃষ্টির ভেতরই অন্যপ্রান্তে দেখা যায় সরকার সাহেব গ্রামোফোনে গান বাজাচ্ছেন ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা’। চন্দ্র অবিকল রেকর্ডের মতো কণ্ঠে একই গান গায়। বৃষ্টির মধ্যেই সেই গান শোনে আমিন ও সাদেক। জংলায় দাঁড়িয়ে জহির এ সময় অঝোর বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। এভাবেই ছবিটিতে বৃষ্টি হয়ে ওঠে দুঃখবোধ প্রকাশের অনন্য মাধ্যম।

চেয়ারে বসে আছেন সরকার সাহেব। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইছে চন্দ্র। তার নাকে নাকফুল, কানে দুল। পরনে শাড়ি। পরিপূর্ণ বাঙালি নারী। তবে চোখে মুখে লেগে আছে না পাওয়ার বেদনার ছাপ। ‘আমি কারো কাছে কিছু চাই না’ বলে চলে যায় শাওন। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে। বাইরে মুষল ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে দেখছে। ক্যামেরা চলে যায় গাছের উপর। গাছের পাতা বেয়ে ঝরতে থাকে বৃষ্টির জল। সিনেমার গল্পে এ যেন অভাগা আর হতভাগ্য শাওনের ভেতরে চেপে রাখা কান্নার বহিঃপ্রকাশ।

‘শ্যামল ছায়া’ ছবির একটি জায়গায় দেখা যায়, রাজাকার কমান্ডারকে ছেড়ে দেবার পর আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। বৃষ্টি নামে। আশালতা বসে আছে। তার পাশেই পাখির খাঁচা। সে বৃষ্টিতে ভিজছে। ছাতা হাতে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায় গৌরাঙ্গ। আবার ফিরে আসে সে মায়ের কাছে। বৃষ্টিতে ভিজতেই থাকে আশালতা। তখন তার মনে পড়ে বিয়ের দিনের কথা, সাত পাকে ঘোরার কথা। এখানে নায়িকার বিরহ, বিষাদ, গৃহআশ্রয়হীন অনিশ্চিত পথযাত্রার করুণ রস সৃষ্টিতে বৃষ্টির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।

‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ঝুম বৃষ্টিতে রঞ্জনা গান ধরে- ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে’। তার আহবানে বৃষ্টিতে ভিজে এবং নাচতে থাকে শিশুর দল। পরে যোগ দেন সোবহান সাহেব, তার দুই মেয়ে-জামাই, ম্যানেজার এবং সামছু। এখানে বৃষ্টি যেন সবাইকে উজ্জীবিত করে তোলে, ভাসিয়ে দেয় আনন্দ সাগরে। 

‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রে ট্রেন লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দিলশাদরূপী মিম। অপরদিক থেকে হুইসেল বাজিয়ে ধেয়ে আসছে ট্রেন। এতে মিমের কোনো ভাবাবেগ নেই। এমন অবস্থা দেখে ছুটে আসে ফেরদৌস। কিন্তু সময়ের মতোই ট্রেনও চলে যায় তার আপন গতিতে। ট্রেন যাওয়ার পর ফেরদৌস দেখে ট্রেন লাইনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মিম। তার একপর্যায়ে শুরু হয় ‘ঝুম বরষায় ঘন কালো মেঘে উল্লাসে নাচি আমি একা...আমার আছে জল’ গানটি। গানের শেষ ভাগে গিয়ে দেখা মেলে বৃষ্টির। এতে মিমকে হাত পেতে বৃষ্টির জল ধরতে দেখা যায়। গায়ে বৃষ্টির জল মেখে উচ্ছ্বসিত মিম ছুটে বেড়ায়। সিনেমার শেষের দিকে হঠাৎ অঝোরে বৃষ্টি নামে। পুরাতন পরিত্যাক্ত বাড়ির দেয়াল কামড়ে উঠেছে লতাপাতা। শেওলা লাগা এ দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির জল। আর দুহাত প্রসারিত করে বৃষ্টিকে আপন করে নিতে দেখা যায় দিলশাদকে। ‘যদি ডেকে বলো, এসো হাত ধরো’ গানের মাঝে মূর্ত হয়ে ওঠে শাওন, জাহিদ হাসান, আর ফেরদৌসের ত্রিভুজ প্রেম, ভালোবাসার অনন্ত টানাপোড়েন। বৃষ্টির বাঁধভাঙ্গা আহ্বানে এক এক করে অঝোর ধরার নিচে এসে নিজেকে মেলে দেয় মিম।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় মেঘমালা ছুটে যাচ্ছে। আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তারপর পদ্মপাতার উপর ঝুম বৃষ্টি পড়তে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বেজে উঠে উচ্চাঙ্গ সংগীতের করুণ সুর। বৃষ্টির গভীরতা আর উচ্চাঙ্গ সংগীতের করুণ সুর দুই মিলে ভীষণ ভারী হয়ে উঠে পুরো চিত্র। এদিকে বৃষ্টিতে ভেজে হামিদা। তা দেখে কমলার চোখে ভাসে ঝুম বৃষ্টিতে ভেলার ওপর দাঁড়িয়ে ছোট বোনের সঙ্গে লাঠি নিয়ে তার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার ছবি। বর্তমানে ফিরে এসে আর্টিস্ট কুদ্দুসের সঙ্গে বৃষ্টির মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মগ্ন হয় সে। পুরনো জমিদার বাড়িতে বৃষ্টির জলে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দেখা যায় আগুনকে। বৃষ্টির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঘেটুপুত্র কমলা নামের কিশোরটিও। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কমলাকে নিজের পরিবারের কথা বলতে শোনা যায়।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়