ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘হুমায়ূন স্যার ছিলেন আলাদিনের চেরাগ’

মাজনুন মিজান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ১৯ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘হুমায়ূন স্যার ছিলেন আলাদিনের চেরাগ’

মাজনুন মিজান: হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে কাজের সৌভাগ্য হয়েছে। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আমার ধারণা, বাংলাদেশে যত অভিনেতা-অভিনেত্রী রয়েছেন তাদের প্রত্যেকেরই স্যারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ ছিল। স্বাভাবিকভাবে আমারও ছিল। তাই আমি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্তু প্রথমে ব্যর্থ হই। পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জার (প্রয়াত অভিনেতা) ভাইয়ের মাধ্যমে স্যারের মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তারপর স্যার আমাকে একটি স্ক্রিপ্ট দিলেন। আমি পড়লাম। স্যারের সঙ্গে বিনা নোটিশে আমাকে তিনদিন কাজ করতে হয়েছিল। ‘কালা কইতর’- স্যারের সঙ্গে  আমার প্রথম কাজ। ধারাবাহিকটি আরটিভিতে প্রচার হয়েছিল। এরপর স্যারের সঙ্গে দুটি সিনেমা, প্রায় ৫০টি টেলিফিল্মে কাজ করেছি।

এক সময় স্যারের পছন্দের মানুষ হয়ে উঠি। স্যার বাসায় যেতে বলতেন, যেতাম, আড্ডা দিতাম। প্রতি বছর বইমেলার সময় স্যারের বাসায় নতুন বই আসতো। স্যার বলতেন, ‘এগুলো আমার নতুন বই, নিয়ে যাও, তোমার স্ত্রীকে দিও।’ স্যার আমার স্ত্রীকে অনেক স্নেহ করতেন, পছন্দ করতেন। কারণ আমার স্ত্রীর নাম মীরা। মীরা স্যারের একটি উপন্যাসের চরিত্রের নাম।

স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, পেয়েছি। লেখক, ঔপন্যাসিক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ ছিলেন। তার সঙ্গে সময় কাটানোটাই সৌভাগ্যের ও আনন্দের। সবসময় তিনি মানুষকে আনন্দ দিতে পছন্দ করতেন। আড্ডার সময় স্যার নানা বিষয়ে কথা বলতেন। যুক্তি দিতেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব বেশি বলতেন না। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কথা বলতেন তিনি। স্যারের পড়াশোনা ছিল প্রচণ্ড। ব্যক্তিগত জীবনে স্যার গাছ খুব পছন্দ করতেন। বৃষ্টি পছন্দ করতেন। কিন্তু মিথ্যা বলা অপছন্দ করতেন। শুটিংয়ের সময় কারো প্রতি স্যার যদি রেগে যেতেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে বলতেন, ‘ফাজিল। ফাজিল তুই কান ধরে উঠবস কর।’ কিংবা ‘কান ধরে ওই পাহাড়ের চারপাশে দৌড়া।’

আমার জন্য হুমায়ূন স্যার ছিলেন আলাদিনের চেরাগ। আমি ক্যারিয়ার নিয়ে যখন ভীষণ ক্রাইসিসে ভুগছি, অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী যখন আমার সঙ্গে অভিনয় করতে চাচ্ছিলেন না। তখন স্যারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারার কারণে আপামর জনসাধারণের অভিনেতা হয়ে উঠি। কারণ স্যারের প্রচুর দর্শক ছিল। সব বয়স, সব পেশার দর্শক ছিল। স্যারের কারণে এই দর্শকের কাছে আমিও পৌঁছাতে পেরেছি।

স্যারের সঙ্গে অনেক স্মৃতি। একবার ধানমন্ডির দক্ষিণ হাওয়ায় শুটিং করলাম। তারপর মৌচাকে একটি বাসায় যাই। সেখানে শুটিং শেষ হয় নি, হঠাৎ স্যারের কী মনে হলো, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ধানমন্ডির বাসায় ফিরে যাবেন। কিন্তু স্যার নিজের গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছেন। ওই সময় আমি একটা গাড়ি ব্যবহার করতাম। স্যার বললেন, ‘মিজান তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবা?’ আমি বললাম, ‘জ্বি স্যার পারব।’ ‘কেমন ড্রাইভ করো তুমি?’ জবাবে বললাম, ‘ভালো ড্রাইভ করি স্যার।’ স্যারকে মৌচাক থেকে ধানমন্ডির দক্ষিণ হাওয়ায় নিয়ে গেলাম। এটা আমার কাছে আনন্দের একটি স্মৃতি। কারণ হুমায়ূন আহমেদ আমার পাশে বসা, আমি ড্রাইভিং সিটে, দুজন কথা বলছি- ভাবলেই সুখানুভূতি কাজ করে।

শুটিং করতে গিয়ে স্যারের কাছে বকা খাওয়ার স্মৃতি কম। কালেভদ্রে বকা খেয়েছি। কারণ সময় থেকে শুরু করে সবকিছু মেইনটেইন করার চেষ্টা করতাম। এটা স্যার পছন্দ করতেন। আরেকটি বিষয় হলো— তিনি অভিনয় না করাটা পছন্দ করতেন। ‘র’ প্যাটার্নের অ্যাক্টিং পছন্দ করতেন। সেটা আমার মধ্যে ছিল বা আছে। আমি ‘র’ প্যাটার্নের অ্যাক্টিং করি, অ্যাক্টিংটা পারি না। বাস্তবজীবনে জীবনযাপন করার অ্যাক্টিংটা করলে দর্শক দ্রুত ক্যাচ করে। লক্ষ্য করে দেখবেন, হুমায়ূন স্যারের নাটকের গল্প খুব সাধারণ মানুষের জীবনের। স্যার এসব জীবন যেভাবে দেখতেন তা অন্য আট দশনের চেয়ে আলাদা ছিল। যে কারণে দর্শক নাটকগুলো দেখলেই মনে করেন— এটা আমার গল্প।

স্যার অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন- এটাই বড় কষ্টের। আরো কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে বাংলা সাহিত্যের জন্য, বাংলাদেশের সিনেমার জন্য ভালো হতো।

অনুলিখন: আমিনুল ইসলাম শান্ত

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুলাই ২০১৯/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়