ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হ‌ুমায়ূন আহমেদ কালজয়ী নয়, মনজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন

ছটকু আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৭, ১৩ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ১৩:৪৮, ১২ নভেম্বর ২০২০
হ‌ুমায়ূন আহমেদ কালজয়ী নয়, মনজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন

হ‌ুমায়ূন আহমেদের ছবি মানেই সবার ছবি। নিন্ম মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তর ছবি। সাধারণ সিনেমা হল থেকে শুরু করে সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার-এর ছবি। সব শ্রেণির দর্শকদের আগ্রহের ছবি। আর এটাই হ‌ুমায়ূন আহমেদের ছবির অনন্য বৈশিষ্ট। তার ছবি সেমিনারে যেমন আলোচিত, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, ছাত্রছাত্রীদের ক্যান্টিনের টেবিলে ও সাধারণ মানুষের ঘরের বৈঠকখানাতেও তেমনি অলোচিত। তিনি নিজে অসাধারণ হয়েও সাধারণের জন্যে সিনেমা বানিয়ে খ্যাতিমান হয়েছেন।

প্রচুর সৃজনশীল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনদিন আর্ট ছবির নামে অবোধ্য ছবি বানানি। তিনি আমাদের অনেক সোকল্ড নির্মাতার মতো লবিং করে দেশি-বিদেশি পুরস্কারের লোভ করেননি। তিনি বগল করে ফিল্মের ক্যান বা ব্যাগে করে ডিভিডি, সিডি বা পকেটে করে পেন ড্রাইভ নিয়ে অস্কার বা কান উৎসবে বিচারকরদের দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়াননি। ছবিতে চাঁদ দেখিয়ে তোষামুদি করে বিচারকদের বলেননি- আমি চাঁদ দেখিয়ে দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের রুটির কথা বলতে চেয়েছি। তিনি গদার, ফেলিনি বা সত্যজিৎ রায়ও হতে চাননি। তিনি চলচ্চিত্রের একজন হ‌ুমায়ূন আহমেদ হতে চেয়েছিলেন এবং হয়েছেন। তিনি নিজের নামেই অখ্যাতি সুখ্যাতি কুড়াতে চেয়েছেন এবং তাতেই তিনি তৃপ্ত থেকেছেন ও দেশের অগণিত ভক্ত দর্শককে তৃপ্ত করেছেন।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানিয়েছেন- ‘আগুনের পরশমণি’ ও ‘শ্যামল ছায়া’। তিনি বাংলাদেশের মাটির ছবি বানিয়েছেন- ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘আমার আছে জল’। তিনি সামাজিক অসঙ্গতির ছবি বানিয়েছেন- ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। হ‌ুমায়ূন আহমেদের ছবিতে আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ আছে, বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র আছে, বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপরস গন্ধ বৈচিত্র আছে, পাখির কলতানের মত সুমধুর সংগীত আছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ সূর্য সন্তানদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছেন তার ছবি ‘আগুনের পরশমণি’। আবুল হায়াত, ডলি জহুর, আসাদুজাজ্জামান নূর, বিাপাশা হায়াত, শিলা আহমেদ অভিনীত এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক পরিবারের ছবি তুলে ধরেছেন। যে পরিবারে এক মক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। শত্রু নিধন করতে গিয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করেছে। মৃতপ্রায় মুক্তিযোদ্ধাকে সেই পরিবার স্বাধীনতার আলো দেখিয়েছে। বলেছে চোখ খুলে দেখো, এক নতুন ভোর তোমাকে আলিঙ্গন করার জন্যে অপেক্ষা করছে। চোখ খোল,  শোন স্বাধীন বাংলাদেশের পাখির কলতান। নতুন ভোরের আলো হাত দিয়ে ছুয়ে স্বাধীনতার পরশ গ্রহণ করো। সংসার সমাজ মুক্তিযুদ্ধকে এক বৃত্তে নিয়ে এসেছিলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। ‘শ্যামল ছায়া’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে ধরে রেখেছেন। হুমায়ুন ফরিদী, তানিয়া আহমেদ, শাওন ও রিয়াজ অভিনীত এই ছবিতে একজন মাঝি ১২জন যাত্রীকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ তিনি গ্রামীণ পটভূমিতে একটি করুণ ত্রিভুজ প্রেমের গল্প তুলে ধরেছেন যার প্রাণ ছিলো বাংলা আবহমান কালের শ্রুতিমধুর সংগীত। জাহিদ হাসান, মাহফুজ, শাওন, মুক্তি, আবুল খায়ের, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ারা, রওশান জামিলকে নিয়ে করা এই ছবি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার লাভ করেছে। এমনকি বৃটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশের সেরা দশটির একটি ছবি হিসাবে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’কে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এই ছবির সব গান ছিলো মনোমুগ্ধকর। একটি ছিলো সোনার কন্যা, পুবালী বাতাস, সোয়া চান পাখি ও আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালে- দর্শক মনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। একটা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এক রহস্য মানবের আগমন নিয়ে ছবি করেছেন হুমায়ূন আহমেদ ‘দুই দুয়ারী’। রিয়াজ, মাহফুজ ও শাওন অভিনীত দুই দুয়ারীকে বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম মিস্টিরিয়াস লাভ স্টোরি।

প্রেম তিনি তার চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন ‘আমার আছে জল’ ছবিতে। বিদ্যা সিনহা মীম, জাহিদ হাসান, ফোরদৌস অভিনীত রোমান্টিক টিনএজার লাভ স্টোরি-এই ছবিতে নবাগতা হিসাবে দারুণ অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার জয় করে নেন মীম। যার পুরো ক্রেডিটই হুমায়ূন আহমেদ-এর। তিনি নির্মাণ করেছেন চাঁদনী পসার রাইতে কে আমায় স্মরণ করে গানের মত অসাধারণ জনপ্রিয় গানের ছবি ‘চন্দ্রকথা’। আসাদুজ্জামান নূর, শাওন, চম্পা, ফেরদৌস, মাহফুজ আহমেদ, আহমেদ রুবেল অভিনীত চন্দ্রকথা  ছবিতে এক বিত্তবান ভূস্বামী তার জীবনের সুখ খুঁজতে এক যুবতী মেয়ের ভালোবাসাকে কিভাবে তছনছ করে দেয় তাই তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি নির্মাণ করেছেন দিতী, তানিয়া আহমেদ, রহমত আলী ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত কমেডী নাটকিয় ছবি ‘নয় নম্বর বিপদসংকেত’।

ইমপ্রেস টেলিফিল্ম থেকে জীবনের শেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ বানিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ঘেটু গানের দলকে দৃশ্যমান করেছিলেন তিনি। ঘেটু দলের নারীবেশী কিশোরদের নিয়ে জলবন্দী অবস্থায় হাওর এলাকার সৌখিনদার বিত্তবান মানুষ নিজেদের কাছে রাখতেন অশ্লীল মনোবাসনা পূর্ণ করতে। বিত্তবানের স্ত্রীরা তাদের সতীন হিসাবে গণ্য করতো। এইরকম ব্যতিক্রমী গল্পের ছবি বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত হয়নি।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ যখন প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে পরিচালক সমিতিতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলন তখন তিনি বলেছিলেন- ছোটবেলা মাসহ পরিবারের সবাই সিনেমা দেখতে যেত দলবদ্ধ হয়ে। আমি রিকশা ডেকে আনতাম। শাড়ি দিয়ে রিকশার চারদিক ঢেকে পর্দা করে পরিবারের সবাই সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখে আসতো। কিন্তু এখন সেই রুচি সমৃদ্ধ পারিবারিক ছবি হচ্ছে না। আমি সেই হলবিমুখ পরিবারের মা-বাবা, ভাইবোনকে হলে ফিরিয়ে আনতে ছবি বানাতে চাই। তিনি যা বলেছেন জীবদ্দশায় সেই ছবিই তিনি বানিয়েছেন। সহজ সরল মানুষ থেকে দূরে সরে গিয়ে শুধু সিনেপ্লেক্সের ছবি বানাননি, বানিয়েছেন অভিসার যমুনা পদ্মার ছবি যা বলাকা, মধুমিতা ও সিনেপ্লেক্সের দর্শকরাও দেখেছেন। মিথ্যে কুসংস্কার তিনি ভেঙে দিয়েছেন। হাসিকে তিনি জীবনের অঙ্গ বলে জড়িয়ে নিয়েছেন। তার চলচ্চিত্র শিল্পের মাপকাঠিতে পরিপূর্ণ উত্তীর্ণ না হলেও দর্শকের মনের প্রচণ্ড রেখাপাত করেছে। তিনি কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি, মানুষের মনজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

 

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়