ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘চাকরিদাতা হতে চাই’

সাইফুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ৪ জানুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘চাকরিদাতা হতে চাই’

শীতকাল। চাদর মুড়ি দিয়ে বন্ধুরা হাঁটছি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়। বেগম খালেদা জিয়া হলের সামনে একটি দোকান দেখে দাঁড়ালাম। স্ট্রিট ফুডের দোকান। ভাবলাম, শীতের মধ্যে গরম কোনো খাবার খেয়ে শরীরটা একটু উষ্ণ করি।

খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি। এই ফাঁকে কথা বললাম দোকানির সঙ্গে। বিস্মিত হলাম। তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র!  

মনু মোহন বাপ্পা। চারুকলা বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে সবাই তাকে ‘বাপ্পাদা’ বলে ডাকে। পরিবারে সংকট ছিল না। তবুও পড়াশোনা চলাকালীন স্বাবলম্বী হতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মনু মোহন বাপ্পা বলেন, যখন আমি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রকে পড়াতাম। হঠাৎ একদিন আমার এক দিদির বিয়েতে যাওয়ার জন্য ছুটির দরকার ছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর ছাত্রের পরীক্ষার কারণে অভিভাবক আমাকে ছুটি দিতে রাজি হননি। তাই ওই ছাত্রকে পড়ানো বন্ধ করে দেই। এতে নিজের খরচ চালাতে অসুবিধায় পড়ি। ভাবলাম, এভাবে বসে থাকলে হবে না। কিছু একটা করতে হবে। তবে যা-ই করি স্বাধীনতা নিয়ে করব।

এরপর অল্প কিছু টাকা নিয়ে শুরু করি টি-শার্ট সরবরাহের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামে টি-শার্টের অর্ডার নিতাম। র‌্যাগ ডে, অ্যালামনাই,পুজো, ঈদ, বৈশাখ, ফাল্গুন ইত্যাদি প্রোগ্রামের জন্য নিজস্ব ডিজাইন নিয়ে আসতাম। অর্ডার অনুযায়ী ঢাকা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কারখানা থেকে এনে সেগুলো গাহকের কাছে পৌঁছে দিতাম। তবে বিভিন্ন প্রোগ্রামের অর্ডার পেতে আমার শিক্ষকরা অনেক সাহায্য করেছেন।

শিক্ষকরা বলতেন, ভালো কিছু করছ কিন্তু পাশাপাশি পড়াশোনা ঠিক রেখ। কয়েকদিনের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে  যেমন- রাজশাহী নগরীসহ ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও নওগাঁর বিভিন্ন কলেজ, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্ডার আসা শুরু করে। বন্ধুদের মাঝে কেউ হাসি-ঠাট্টা করত। অনেকে অবশ‌্য উৎসাহও দিয়েছে।

আমার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ক্যাম্পাসের এক ছুটিতে বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি, গ্রামের এক লোক ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছে। অবাক হলাম! ভাবলাম, এমন একটি দোকান আমার ক্যাম্পাসে দিলে মন্দ হয় না। দোকানটি দিলে আমি দুয়েকজনের কর্মসংস্থান তৈরী করতে পারব। পরে ক্যাম্পাসে এসে প্রতিদিন ২০০ টাকা অথবা মাসে ৬ হাজার টাকা দেয়ার শর্তে একটি ভ্যান ভাড়া করি। বেগম খালেদা জিয়া হলের সামনে জায়গা ঠিক করে চালু করি দোকানটি।

দোকানে বার্গার, স‌্যান্ডউইস, চিকেন ফ্রাই, নুডুলস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি বিভিন্ন খাবার ছিল। তবে কিছুদিন পর দোকানটি বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ ভ্যানের ভাড়া পরিশোধ করতেই আমার লভ্যাংশ প্রায় শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ও নিজের কিছু জমানো টাকা দিয়ে একটি ভ্যান তৈরি করি। দোকানটি আবার শুরু করি এবং নাম দেই ‘রেইনবো ফুডিজ’। প্রথম দিন দেখে বন্ধু ও পরিচিতজনেরা অবাক হয়ে নানান কথা বলা শুরু করে। কিন্তু কারো কথা মাথায় তুলিনি। নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেয়া শুরু করি। আমি সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা অথবা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস করি। আর বিকেলে দোকানে সময় দেই। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখি। পরীক্ষা থাকলে আগের দুদিন দোকানে আসি না। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বিক্রি হয়। গড়ে প্রতিদিন চার-পাঁচশ টাকা আয় হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দোকান দেয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কম মূল্যে ফাস্ট ফুড খেতে পারবে। ক্যাম্পাসে আমি প্রথম এ ধরনের দোকান শুরু করেছি। বেশ সাড়াও পেয়েছি। এখন আমি অনেকটাই স্বাবলম্বী ও তিনটি দোকানের মালিক। ক্যাম্পাসে একটি ও বাইরে দুটি দোকান রয়েছে। তবে একটি রেস্তোরাঁ খোলার ইচ্ছে আছে। সেটি হবে ব্যতিক্রম। কারণ আমরা দিন দিন মাছ-মাংসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছি। তাই মাছ-মাংস ছাড়া ভর্তা ও সবজির আইটেম থাকবে সেখানে। 

এছাড়া আটজন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরে আমি আনন্দিত! আমার দেখাদেখি অনেকেই এ ধরনের দোকান দেয়ার জন্য আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসেন। আমি এখন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজে ভালো কিছু করার পাশাপাশি সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করতে চাই। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত উপলদ্ধি এই যে- সবাই যদি চাকরির পেছনে দৌঁড়ায় তাহলে চাকরিটা দেবে কে? আমি চাকরিদাতা হতে চাই। পড়াশোনা শেষ করার পর ব্যবসা করার ইচ্ছা আছে। কিছু টাকা জমাতে পারলে কিংবা সরকারি বা বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ পেলে ব্যবসাটি আরও বড় করার ইচ্ছা আছে।

 

রাবি/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়