ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উদ্যোক্তার গল্প

‘নেতার বউ কাপড় বেচে’

স্টার্লিং ডি মামুন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ১২ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘নেতার বউ কাপড় বেচে’

আমরা বাঙালি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। বাংলায় কথা বলা, বাংলার সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরা আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বাংলা বাঙালির আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা। সেই ভালোবাসার জায়গা থেকেই কেউ কেউ তার প্রতিষ্ঠানের নামকরণই করে ফেলেন বাঙলা/বাঙালি।

আজ শোনাবো বাঙলা ও বাঙালিকে বুকে লালন করা এক উদ্যোক্তার কথা।

স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তা উর্মী রহমান। জন্মেছেন বাঘের শহর, সুন্দরের শহর খুলনা জেলায়। দক্ষিণের আরেক জেলা মাদারীপুরে বিয়ে করে বউ হয়েছেন। উর্মী রহমান গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন অনেক আগেই। পড়ালেখার প্রতি অসীম ঝোঁক থাকার দরুণ সংসার, ব্যবসা সব সামলিয়ে পুনরায় পড়ালেখা শুরু করেছেন, পড়ছেন ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজে।

ছোটবেলা থেকেই চিন্তা ছিল চাকরির পেছনে না ঘুরে ব্যবসা করবেন৷ হবেন উদ্যোক্তা। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবেন। বাংলাকে ভালোবেসে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘বাঙালি’।

দেশীয় সব পণ্যে আধুনিকতার ছোঁয়ার মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা মেটাচ্ছেন। সম্পূর্ণ বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি। অর্থাৎ সব পণ্য মেইড ইন বাংলাদেশ। পোশাক থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত সব পণ্য তার এখানে মেলে।

উর্মী রহমান জানান, দেশে তৈরি হওয়া সব মানসম্মত পণ্য আধুনিক রূপে উপস্থাপন করা এবং দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করাই বাঙালির লক্ষ্য। বাঙালির উদ্দেশ্য, সব পর্যায়ের কাস্টমার। অর্থাৎ ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকার পণ্য পাওয়া যায় তার আউটলেটে। যাতে সবার ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে।

বাঙালি দেশীয় সব পণ্য নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু শুরুটা হয় জামদানি পণ্য দিয়ে। জামদানি বলতে শুধু শাড়ি নয়। জামদানি পাঞ্জাবি, ওয়ান -পিস, টু-পিস, থ্রি-পিস, গয়না, ব্যাগ, গয়নার বক্স ইত্যাদি। এখন তো জামদানি গাউন, লেহেঙ্গাও তৈরি হয়। এর সাথে উর্মি রহমানের  বাঙালি  বর্তমানে কাঠের গয়না, গৃহস্থালি সাজসজ্জার পণ্য, হ্যান্ড পেইন্ট পণ্য,  তাতঁজাত পণ্য, সিল্ক,  হাতের কাজের পণ্য ইত্যাদি নিয়েও নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।  আরও নতুন প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে।  তারা আশা করছেন, ধীরে ধীরে পরিধি বাড়বে কাজের।

স্বপ্নবাজ এই উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে ৫ বছর ধরে। নিজের বাসার সাথে একটা রুম নিয়ে উর্মি রহমান কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন বড় আউটলেট হবে, ফ্যাক্টরি হবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

উর্মী বলেন, ‘একেবারে নিজের হাতে আমি সব কিছু করি। আপাতত সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে, শো রুম নেই। আমার নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের কারিগর দিয়ে পণ্য তৈরি করি। আমার হাজবেন্ড অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান দূর্জয় এবং আমার ছোটবোন অদিতি হাফিজ শর্মী আমরা সবাই মিলে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এছাড়া সহযোগিতা করার জন্য আরো ২ জন লোক রয়েছে।’

‘চাকরি করার ইচ্ছে আমার কোনো দিন ছিল না। পেশা হিসেবে আইন পেশা পছন্দ করেছি সবসময়। সেটার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর আমি চেয়েছি মেয়েদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে। আমার কোনো কাজে যদি ২ জন নারীও আত্মনির্ভরশীল হয়, আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। এই লক্ষ্যে আমার বিজনেসের পাশাপাশি ‘নারী উদ্যোক্তার খোঁজে’ নামে ১২ হাজার সদস্যবিশিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি সংগঠন পরিচালনা করছি। যেখানে নুতন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্য পথ দেখানো হয়’, বলেন উর্মী। 

প্রশ্ন ছিল উদ্যোক্তা হিসেবে চ্যালেঞ্জ কী? তিবি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সমাজব্যবস্থা। আমার সৌভাগ্য হয়েছে, আমার পরিবারের সাপোর্ট পাওয়ার। কিন্তু সবাই সেটা পায় না। একটা মেয়ের জন্য বিয়ের আগে বাবা এবং বিয়ের পরে স্বামী। এই ২ জনের মানসিকতা একটা নারী উদ্যোক্তার জীবনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমি আমার আব্বু এবং আমার স্বামী দুজনকেই আমার শক্তি হিসেবে পাচ্ছি।’

‘এসমাজ মনে করে, ব্যবসা ছোট কাজ। যে কাজকে ছোট মনে করে, সে কোনো দিন উন্নতি করতে পারে না। উদ্যোক্তা জীবনে কখনো কারিগর, কখনো ডিজাইনার, কখনো ডেলিভারি বয় হতে হয়। আমি মালিক আমি কেন করব, এসব চিন্তা দূর করা উচিৎ। আর একটা কথা বলব, যতক্ষণ আপনি জীবনে কিছু অর্জন করতে না পারবেন, ততক্ষণ আঙুল তোলার মানুষের অভাব হবে না। কষ্ট করে কিছু অর্জন করুন, সবাই তখন কৃতিত্ব নিতে হাজির হবে৷ তাই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের জানতে হবে’, বলেন তিনি। 

উর্মী রহমানের স্বামী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে অনেক সময় কটুক্তিমূলক কথা শুনতে হয়েছে যে, ‘নেতার বউ কাপড় বেচে’!

উর্মী রহমান গর্ব করে বলেন, ‘আমার হাজবেন্ড সব কাজে আমার সাথে থাকেন। তাকেও এটা নিয়ে তার বন্ধুমহল থেকে কটুক্তি শুনতে হয়। বাবার বাড়ির দিক থেকে আমাদের পরিবার মোটামুটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার। এই মধ্যবিত্ত সমাজ সবচেয়ে বেশি আলোচনা সমালোচনায় থাকে। সুতরাং এই সমাজের প্রেক্ষাপটে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বা হচ্ছে। আমার আম্মু সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করছে। শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই আম্মু আমাকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগাচ্ছেন। পথ অনেক কঠিন হলেও বলব, ভালো আছি।’

স্বপ্ন দেশি পণ্যকে আধুনিক, মানসম্মত, এবং বাজেট ফ্রেন্ডলি করে উপস্থাপন করতে পারার। অবশ্য দেশি পণ্য দেশের বাইরে উপস্থাপন করতে চান উর্মি রহমান। তাছাড়া দেশি পণ্য দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে চান। তিনি মনে করেন, দেশে ক্রেতা আছে, তাই সবসময় নিজেদের প্রতি আস্থা আগে ফিরিয়ে আনতে হবে।

নতুনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নুতনদের বলব, অন্যদের অনুকরণ না, যেটা করে আপনি নিজে শান্তি পাবেন, নিজে ভালো বোঝেন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেটাই শুরু করুন। শুরু করলেই সফল হয়ে যাবেন এমন না। তাই হতাশ হবেন না। একটু ধৈর্য ধারণ করে সেটাকে ধরে রাখবেন। তাহলেই সফলতা।’

লেখক: তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ঢাকা/হাকিম মাহি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়