ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সার্থক উপাখ্যান ‘শরণার্থী শিবির থেকে’

আবেদীন জনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সার্থক উপাখ্যান ‘শরণার্থী শিবির থেকে’

আবেদীন জনী: যুদ্ধদিনের অজস্র বেদনার হাহাকার, মা-মাটিকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রাখার অগ্নি শপথ শব্দসুতোয় গেঁথেছেন কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী। তিনি কিশোর পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন একাত্তরে হঠাৎ নক্ষত্র-দানার মতো তীব্রভাবে জ্বলে ওঠা স্বপ্নবীজ। যে স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়েছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই ভূ-খণ্ডে। সেই খণ্ডস্মৃতি বিনির্মিত শিল্পসমৃদ্ধ এক অনবদ্য সার্থক উপাখ্যান ‘শরণার্থী শিবির থেকে’। এটি কিশোর উপন্যাস।

একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এদেশের সহায়-সম্বলহীন রোগে-শোকে ক্লিষ্ট, পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত স্বজনহারা বিপন্ন বিমর্ষ  মানুষগুলোর জীবনচিত্র এই উপন্যাসের  মূল উপজীব্য। কিন্তু এই আখ্যানের বয়ানরীতি, গল্পের কাঠামো নির্মাণ-পরিকল্পনা এমন অভিনব কৌশলে, অত্যাশ্চর্য সুনিপুণ দক্ষতায় করা হয়েছে যে,  আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পারিপর্শ্বিক পরিস্থিতিসমূহ দীপ্তমান হয়ে উঠেছে। সে হিসেবে ‘শরণার্থী শিবির থেকে’ গ্রন্থের লেখক শক্তিমান গদ্যকার। সচেতন পাঠক উপন্যাসটি পাঠমাত্র লেখকের মেধাশক্তির পরিচয় পাবেন।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিপুল পরিমাণ গল্প-উপন্যাস আমাদের সাহিত্য-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। ‘শরণার্থী শিবির থেকে’ মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি-নির্ভর উপন্যাস হলেও এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমার জানা মতে, এটিই শিশুকিশোরদের জন্য শরণার্থী ক্যাম্প উপজীব্য প্রথম উপন্যাস। একইসঙ্গে এটি সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস এ কারণে যে, কিছু মুদ্রণত্রুটি বাদ দিলে এখানে মেলে সুবিন্যস্ত আখ্যান, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ ও সমাজ বাস্তবতা। এই বিষয়গুলোর যথাযথ চিত্রায়ণ উপন্যাসটিকে দিয়েছে পূর্ণ শারীরিক কাঠামো। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটাই নিখাঁদ সত্য যে, কাহিনি বর্ণনা, যথাযথ পরিচর্যা, পটভূমি উপস্থাপন, চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষাশৈলীর প্রয়োগ, বিষয় ও ভাষার সামঞ্জস্য বিধান উপন্যাসকে সার্থক ও সুখপাঠ্য করে। আরও একটি বিষয় হলো, সার্থক উপন্যাস পাঠ করে পাঠক জীবনের মনস্তাত্ত্বিক দিকসমূহ এবং কোনো সত্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আলোচ্য আখ্যানটিতে গুরুত্বপূর্ণ এই উপকরণগুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।

একটি কথা বলে রাখা ভালো। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠককে বারবার হোঁচট খেতে হবে। মুদ্রণত্রুটিজনিত হোঁচট নয়, ভাষাগত জটিলতা নয়, গল্পের অস্পষ্টতাজনিতও নয়। তাহলে কেন হোঁচট খেতে হবে? হৃদয়ের নরম পায়ে গল্পের প্লট ধরে পাঠক যখন হাঁটবে, পৃষ্ঠা উল্টাবে, তখন মাঝেমধ্যে করুণ ব্যথায় বুক ভেঙে যাবে। কান্না আসবে। নীলাভ জলের আয়নায় অস্পষ্ট মনে হবে অক্ষরগুলো। শব্দগুলো। পাঠক বাকরুদ্ধ হবে। এভাবে কিছুক্ষণ পার হবে। তারপর হঠাৎ হাস্যরসাত্মক কোনো উজ্জীবনী বাক্য ছুঁয়ে নৈঃশব্দ্যের গভীর থেকে পাঠক জেগে উঠবে আবার। শরণার্থী শিবিরের কোটি মানুষের জীবনযন্ত্রণার ধোঁয়াটে দীর্ঘশ্বাসে ছাওয়া তীব্র হাহাকারের ভেতর থেকে হ্যাঁচকা টানে পাঠককে জাগিয়ে তুলে দেশের জন্য প্রাণ বাজি রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে এই উপন্যাস। এমনই তারা ভাষার ব্যঞ্জনা।

মুক্তযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা মৌলিক এ কিশোর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মূলত অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া তের বছর বয়সের পিতাহীন এক মেধাবী কিশোর। নাজমুল ইসলাম বাবু। ছেলেবেলায় পিতাহারা বাবুর মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে অসহায় বাবু ঢাকা শহরে বোন দিলারার বাসায় আশ্রয় নেয়। সেখানে সে পড়ালেখার পাশাপশি নিজের খরচ চালানোর জন্য ঠোঙ্গা কারখানায় কাজ করে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি নরপশুবাহিনী এদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ওপর শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে রাতে বাবুর দুলাভাই নিখোঁজ হন। জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা গ্রামের বাড়ি রওনা হয়। হোসেনপুর পৌঁছালে তারা পাকসেনাদের কবলে পড়ে। দিলারার বুকের ধন শিশুসন্তানকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দিলারাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বাবুকে লাথি মেরে নদীতে ফেলে দেয় পাকসেনারা।  ভারতের বাঘমারা শরণার্থী শিবিরে রওনা হওয়ার দিন এক হিন্দু পরিবারের প্রধান গিরিশচন্দ্র অর্ধমৃত অবস্থায় বাবুকে নদীতে ভাসতে দেখে। সেখান থেকে তুলে এনে বাবুকেও সঙ্গে নিয়ে যায় ভারতে। নিজ সন্তানের মতো আদর-যত্নে সুস্থ করে তোলে তাকে। শরণার্থী শিবিরের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, রোগে-শোকে মানুষের মৃত্যুর মিছিল, সোমেশ্বরী নদীর জলে ভেসে যাওয়া শত শত লাশ আর বালুচরে শেয়াল-কুকুরে খাওয়া ছেঁড়াখোঁড়া শবদেহ দেখে বাবু নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মুক্তিপাগল তরুণ নারায়ণের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢুকে পড়ে দেশে। আর সেই অঞ্চলের কোনো এক গ্রামে রয়ে গেছে তার মা। আর পাকসেনাদের হাতে বন্দি বোন দিলারা। বোনকে যে উদ্ধার করতেই হবে। এমন আকুতি নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে একদিন মায়ের সাথে দেখা হয়। বাবুর নির্ভুল ম্যাপিং ও বুদ্ধিমত্তায় সম্মিলিত আক্রমণে উড়িয়ে দেয়া হয় গুরুত্বপূর্ণ বানাসি ব্রিজ। আক্রমণ করা হয় হোসেনপুর পাকসেনা ক্যাম্প। সব হানাদার ধ্বংস করে জয়ী হয় বাংলা মায়ের সূর্যসন্তানরা। বাবু ক্যাম্পের এখানে-ওখানে খুঁজে বেড়ায় প্রিয় বোনকে। কিন্তু পায় না। হঠাৎ এক কক্ষে খুঁজে পায় বোনের সবুজ শাড়ি। মাঝখানে তার জমাট বাঁধা রক্ত। এ যেন রাত পেরিয়ে উদিয়মান ভোরের রক্তিম সূর্য। এই হলো ‘শরণার্থী শিবির থেকে’ উপন্যাসটির সারসংক্ষেপ ।

যারা শরণার্থী শিবিরের ইতিহাস জানে না, মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা ইতিহাস তথা মৃত্যুঝুঁকিতে ভরা সম্মুখযুদ্ধ সম্পর্কে  জানে না, তাদের বইটি পাঠ করা জরুরি। আর কিশোরদের জন্য তো অবশ্য পাঠ্য। কারণ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড়ো শক্তির জায়গা। স্বপ্নের জায়গা। আজও দুর্যোগে-বিপ্লবে, অশুভ আঁধারের বিরুদ্ধে লড়তে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শক্তির জোগান দেয়। বঙ্গবন্ধু আমাদের সাহস দেয়। আমরা যেসব স্বপ্ন দেখি, সবগুলোয় স্বাধীনতা থেকে পাওয়া, মুক্তিসেনার রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরিত।  কিশোররা এসব না জানলে কেমন করে বড় হবে তারা? কেমন করে স্বপ্ন দেখবে দেশ গড়ার? মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বাঙালির বীরগাঁথা আমাদের কিশোর-তরুণরা বুকের ভেতর ধারণ করতে না পারলে তাদের হাত-পা-শরীর বড় হবে, কিন্তু মন বড় হবে না। বুকের ভেতর জমা হবে না ভয় তাড়ানোর মন্ত্র। মন হবে না সৃষ্টিশীল। ভাবনার ভেতর সৃষ্টি হবে না স্বপ্নসড়ক।

কিশোর উপন্যাস ‘শরণার্থী শিবির থেকে’ প্রকাশিত হয়েছে চিত্রা প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আইয়ুব আল আমিন। মূল্য: ২০০ টাকা ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়