ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বইমেলায় নীরা লাহিড়ীর উপন্যাস যুদ্ধ

সাইফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বইমেলায় নীরা লাহিড়ীর উপন্যাস যুদ্ধ

অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে নীরা লাহিড়ীর তৃতীয় উপন্যাস যুদ্ধ।

এটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। উপন‌্যাসে লেখিকা ভেতরের ক্যাপশানে প্রথম যে বাক্যটি লিখেছেন তা হলো- যুদ্ধ সেত অনিবার্য- এই মধুর মোহন ভুবনময় যুদ্ধক্ষেত্র। সুদূরকালের অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতবর্ষ থেকে বর্তমানের স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সময়, প্রকৃতি, জীবন, সম্প্রদায়, ধর্ম, প্রেম, অর্থনীতি নিয়তই যুদ্ধের বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত। রাজনীতির কৌটিল্য যেমন জন্ম দিয়েছে ঔপনিবেশিকতা, অপক্ষমতা, মন্বন্তর, উদ্বাস্তু। সমাজনীতি জীবনকে ত্যক্ত সম্প্রদায়িকতা প্রেমহীন দুস্তর পারাবারে ধর্মধ্বজায় সমাহিত করেছে। অর্থনীতির মুগুরে দারিদ্র্যক্লীষ্ট মনন আর ক্ষমতালিপ্সু দুর্দণ্ড প্রতাপ ক্রমেই জীবনগ্রাফের দুটি বিপরীত বিন্দুতে বিসর্জিত হয়েছে। প্রকৃতি এই সমাজ সংসারের লীলভূমিতে সদা ক্রীড়ারত। কখনও ঝঞ্জাবর্তে কখনও পুস্পনন্দনে ধর্ষিত, বিমোহিত মানবকূল। এই আবর্ত আর প্রত্যাবর্তের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে। চিরাচরিতভাবে সৃষ্টিশীলতার যোগ্যমূল্য বিবেচিত হয়নি, মানবিকতা বিক্রীত হয়েছে, দানবীয় বোধে। দ্বন্দ্ব-অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম-অপ্রেম, ধর্ম-অধর্ম, বিবেক-নিষ্ঠুরতার এই যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়তই যোদ্ধা মানুষ। তাকে ত জয়ী হতেই হবে শত পরাজয়ের গ্লানি পিছনে ফেলে।

গান্ধীজী যেমন পারেননি তাঁর অসীম প্রজ্ঞা আর অহিংস নীতি দিয়ে দেশভাগ ঠেকাতে, থামাতে রায়টের বিভৎস জিঘাংসা তেমনি সাধারণ মানবিকতা বোধসম্পন্ন বাহার যিনি কিনা ছিলেন গান্ধীর ছায়া-সঙ্গী তিনিও মেনে নিতে পারলেন না ধর্মের ভিত্তিতে   ভারত মায়ের বিভক্তি। গঙ্গার পবিত্র বক্ষে আত্মাহুতি দেন বাহারউদ্দিন। ধর্মের চাইতে ভারত মায়ের অবমাননা তাঁর আত্মাকে কলুষিত করে তুলেছিল।

উদ্বাস্ত বিহারীরা এলো, দেশ ভাগ হল। স্থানীয় হিন্দু আর মাড়োয়ারী সম্প্রদায় ত্রাহিত্রাহি রবে নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোর লড়াইয়ে মগ্ন। বাহারপুত্র বাহানুদ্দিন ক্ষেত-খামার আর রেলওয়ের চাকরি করে কায় ক্লেশে দিন যাপন করে। সৈয়দপুরের বিহারী সম্প্রদায় থেকে বাঙ্গালীদের অস্তিত্ব টেকানোই দায় তখন। পাকিস্তানি  সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিহারীরা ক্রমে প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু মুজিবুল্লাহর মতো মাইগ্রেটেড  বিহারীরা মানবিক ছিল- যাদের সংখ্যা হাতে গোনা। বাহানুদ্দিন পুত্রদের শিক্ষিত করতে চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে ৭১’ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পুত্র জামিল চলে যায় যুদ্ধে। কন্যা সালেহা ধর্ষিত হয়।

বিহারী, রাজাকার আর আর্মির সম্মিলিত যুদ্ধক্ষেত্র-সৈয়দপুর। বাহানুদ্দিন আর তার স্ত্রীর মৃত্যু হয় ক্রমাগত মানসিক পীড়ণে। পিতৃমাতৃহীন স্বাধীন বাংলার ভিটায় ফিরে আসে জামিলউদ্দিন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জামিলউদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট যেন তামাসায় পরিণিত হয় সৈয়দপুরের বিহারী-রাজাকার অধ্যুষিত জনজীবনে। ব্যর্থ জামিলউদ্দিন হতাশাগ্রস্ত। মুহিবুল্লাহ্ও পারেননি তাঁর পুত্র আক্রামের নীতি ভ্রষ্ট রাজাকার জীবন মেনে নিতে। আক্রাম বোন রাবেয়াকে নিয়ে চলে যায় পাকিস্তানে। আসলাম, রোকেয়া-পিতা মুজিবুল্লাহর মতো এই বাংলাকে ভালো বেসেছিলেন উদ্বাস্তু বিহারী পরিচয় মুছে হতে চেয়েছিলেন খাঁটি বাঙালি। মুক্তিযোদ্ধা জামিলউদ্দিন এর মধ্যে প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়েছে রোকেয়ার সাথে।

এ বিবাহকে তিরস্কার করে জামিলউদ্দিনের পরিবার। বড়ভাই শমসের তীব্র ভাষায় অনুযোগ করে তোর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় আর্মির অত্যাচারে মৃত্যু হয় বাবা- মায়ের, সেই তুই বিহারী কন্যা ঘরে তুলে আনলি!

কিন্তু রোকেয়া এমাটিরই কন্যা মননে, আত্মায়, চিন্তায়। এ দেশ, এ ভাষা তার প্রাণ যেমন প্রাণ ছিল  ভাই আসলামের, পিতা মুজিবুল্লাহর। মুজিবুল্লাহ্ আসলাম বাধ্য হন সব বিক্রি করে পাকিস্তানে পুত্র আক্রাম ও কন্যা রাবেয়ার কাছে চলে যেতে। রোকেয়ার যুদ্ধ শুরু হয় জামিলউদ্দিনের সংসারে। ভাষার যুদ্ধ, প্রেমের যুদ্ধ, সন্তান স্নেহের যুদ্ধ।

পুত্র মিলন হয়ে ওঠে নাট্যকার, কবি, জার্নালিস্ট।, জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা শামসেরের তীব্র বিরোধিতা এবং সৈয়দপুরের পুননির্বাসিত বিহারী- রাজাকারদের দাপটে পর্যুদস্ত মুক্তিযোদ্ধা জামিলউদ্দিন সংসার চালাতে হিমশিম খান। প্রতিটি ব্যবসা, চাকরি, কর্মক্ষেত্র দখল করে রাখে সেই পাকিস্তানপন্থীরা। সৈয়দপুর স্বাধীন বাংলায় একখণ্ড পাকিস্তান। মিলনও তার প্রাপ্য অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়। প্রতিদিন কাগজের মালিক, মিডিয়ার মালিক তার রচিত নাটকে সমৃদ্ধ করে তাদের ব্যাংক ব্যলেন্স। সংসারের তীব্র চাহিদা মিলনকে ক্লান্ত, বিরক্ত, হতাশ করে তোলে।

একমাত্র ফুল, পুষ্পকন্যা ফুল তাকে জড়িয়ে রাখে অপার কোমলতায়। সেখানেও ধর্ম-সংস্কার, সমাজ-পরিবার রক্তাক্ত চক্ষুমেলে উপস্থিত প্রতিদিন, ব্রোকেন পরিবারের মেয়ে ফুল যুদ্ধ দেখে অভ্যস্ত প্রতিদিনের সংসারে। বিবাহ ও সংসারে তার তীব্র অবিশ্বাস। তবু মিলনের প্রেম তার বিক্ষুদ্ধ জীবনে একমাত্র শান্তির প্রলেপ, কিন্তু প্রকৃতি সে যুদ্ধেও হারিয়ে দেয় ফুলকে। মিলন হারিয়ে যায় সমুদ্রের ঘুর্ণাবর্তে।

দেশে, মাটি, জন্ম, জাত, ধর্ম, প্রেম, ভাষা, পরিচয়, রোগ-শোক প্রকৃতির দুর্বহ বৈরিতা আর আনন্দলোক এসব মিলিয়ে যুদ্ধের বিন্যাস। লেখিকা কতটুকু বিন্যস্ত করতে পেরেছেন সময়কে তা বিচারের ভার পাঠকের।

 

ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়