ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নাজমুলের লড়াই

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নাজমুলের লড়াই

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: ওরা কেউ করতো টোকাইয়ের কাজ, কেউ ইট ভাঙার কাজ, কেউ কল-কারখানায় কাজে যেত। শিশুশ্রম গিলে খাচ্ছিল ওদের সোনালী শৈশব। ওখানে দিনের আলো ঠিকই ছিল, কিন্তু শিক্ষার আলো ছিলো না। ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ ও স্মৃতিসৌধের পাশেই গড়ে ওঠা নিরিবিলি বস্তির চিত্র ছিল এমন।

নিরিবিলি বস্তির শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে এগিয়ে এলেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাস করা তরুণ চিকিৎসক নাজমুল হোসাইন। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে গড়ে তুললেন ‘অ আ ক খ স্কুল’। স্কুলটি খুব কম সময়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই বস্তিতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বস্তির ৯০টি পরিবারের শিশুরা এখন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুলের আনন্দমুখর পরিবেশে কথা হয় প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হোসাইনের সাথে। তিনি বলেন, ‘হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য স্কুলটি গড়ে তুলি। তখন মন খুব খারাপ ছিল। সার্জারিতে কৃতকার্য হতে পারিনি। আবার পরীক্ষা দিতে হবে, তা-ও বেশ দেরিতে। ভাবছিলাম অবসরে কী করা যায়? একদিন ইউটিউবে দেখলাম, ফাদার লুসিও নামে ইতালির এক নাগরিক বাংলাদেশের পথশিশুদের লেখাপড়া শেখান। এই তথ্যটি আমার ভাবনা বদলে দিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জন্য আমিও কাজ করব। সেই থেকে শুরু।’

স্কুলের নাম রেখেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন। স্কুলের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৯ মে। এগিয়ে এলেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডা. হাসান, ডা. সারোয়ার, ডা. আবুল বাশার, ডা.সাদ্দাম, ডা.রথি, ডা.ফাবিহা, রুবেল ও ইরফান। তারা নানাভাবে উৎসাহ দিলেন, সাহায্য করলেন। এভাবেই ৬০ জন শিশুকে নিয়ে শুরু হলো প্রথম ক্লাস। স্কুলের শিক্ষক আটজন। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। স্কুলের পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। কিন্তু প্রথম যে ঘরটি ব্যবহৃত হতো দেখা গেল, বৃষ্টির দিন চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাস করতে হয়। তারপরও তারা অনেক কষ্ট করে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন বাড়ির মালিক। তিনি রুমটিতে স্কুলের কাজ চালানোর অনুমতি দিলেন না। অভিযোগ, কেয়ারটেকার নাকি তার অনুমতি না নিয়েই রুম ভাড়া দিয়েছে। সুতরাং সেই রুম ছেড়ে দিতে হলো। এরপর বাধ্য হয়ে খোলা মাঠে ক্লাস চলল কিছু দিন। প্রচণ্ড রোদে ছাত্রছাত্রীরা হাঁসফাঁস করে। বৃষ্টি হলে তো দুর্ভোগের শেষ নেই।

 


এক সময় দেখা গেল মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীদের দানের টাকায় কেনা খাবার দিয়েও ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। মা-বাবারা ওদের ময়লা কুড়ানোর কাজে লাগান। বস্তি ঘুরে ঘুরে তখন ছাত্রছাত্রী জোগাড় করতে হয়েছে নাজমুলদের। একদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন স্থানীয় এক সমাজসেবক। নাম বেলাল। তিনি রাস্তার পাশের এক দোকানে ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। তবে ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়ার চেয়ে পথের দৃশ্য দেখতেই বেশি মনোযোগী। ফলে আবার নতুন একটি জায়গা খুঁজতে লাগলেন নাজমুল। পেয়েও গেলেন। এক ভদ্রলোক প্রায় ২৫ শতক জমিতে পাঁচটি ঘর ভাড়া দিয়ে স্কুল চালানোর অনুমতি দিলেন। চলতি বছরের ১ মে থেকে সেখানেই চলছে স্কুল। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য ফুলের বাগান করা হয়েছে। দেয়ালে আঁকা হয়েছে মীনা কার্টুনের নানা দৃশ্য। টিনগুলোও রঙিন হয়েছে। ভালো কার্যক্রম হওয়ায় আর্থিক সাহায্যও পেতে শুরু করেছেন তারা।

এক পর্যায়ে খন্দকার সালেক নামের এক চাকরিজীবী সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন। তাদের প্রতিষ্ঠান ‘টেক্সপ্রেগ্রো’ থেকে মিলল সহায়তা। ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ব্যাগ-খাতা-কলম, পোশাকের জন্য তারা সহায়তা করল। শুধু তাই নয়, লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার উপকরণও মিলল সেখান থেকে। নাজমুল তাদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে বলেন, ‘স্কুলের জন্য অনেক সাহায্য করেছে টেক্সপ্রেগ্রো। তারা শুরু থেকে আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’
টেক্সপ্রেগ্রোর সিএসআর প্রধান খন্দকার সালেক রাইজিংবিডিকে বলেন, টেক্সপ্রেগো সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সচেতন। এই দায়বদ্ধতা শুধু সমাজের অবহেলিত মানুষকে নিয়ে নয়, আমরা আমাদের পণ্যের উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে এই দায়বদ্ধতা বজায় রাখি। সকল প্রতিষ্ঠান যদি তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করে তাহলে নাজমুলদের মতো উদ্যোগী লোক পৃষ্ঠপোষকতা পাবেন। দেশ তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে।’

প্লে-গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুল চলছে মানুষের সাহায্যে, মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীদের চাঁদায়। স্কুলটিতে শাপলা, গোলাপ, জবা, বেলি, জুঁই- পাঁচটি বিভাগে ক্লাস হয়। ২০ জন ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীকে ২০১৭ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে স্কুলটি পূর্ণাঙ্গ স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করবে। এই স্কুল থেকেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুগুলো পিএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে। সরকার নির্ধারিত সিলেবাস পড়ানো হবে। অন্যান্য আধুনিক স্কুলের মতো তারাও ছাত্রছাত্রীদের প্রগ্রেস রিপোর্ট তৈরির কাজ করছেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করছেন। শিশুদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্য করছেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র উৎসব। এখন স্কুলে প্লে-গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে মোট ৬৫ জন ছাত্রছাত্রী আছে। স্কুল নিয়ে তারা বেশ খুশি। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ঝর্না আক্তার। তার মতে, ‘কোনো দিন স্কুলে যাব, ভাবতেই পারিনি। বস্তিতে থাকি বলে আমাদের সবাই ঘৃণা করে। এখন আমরা অন্য সব শিশুর মতো লেখাপড়া করতে পারছি।’

 


সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কাগমারি চরের শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য অ আ ক খ স্কুলের আরেকটি শাখা চালু করেছেন নাজমুল। স্কুলের সব তথ্য পাওয়া যাবে তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট: facebook.com/oakokho.school - থেকে। স্কুলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আদলে একটি লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা আছে নাজমুলের। এ জন্য ইভানা শামস নামক এক প্রবাসী এগিয়ে এসেছেন। তিনি গত একুশে গ্রন্থমেলায় তার কবিতার বই বিক্রির ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। আরো টাকা জোগাড় হলে লাইব্রেরি গড়ে তোলা হবে। নাজমুল এবং তার বন্ধুরা গত ১৯ মে স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছেন। সেই আয়োজনে আরো অনেকের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. লায়লা পারভীন বানু। তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছেন যে, প্রতিমাসে অর্থ সাহায্য দিয়ে যাচ্ছেন। ডা. লায়লা পারভীন বানু বলেন, ‘শিক্ষায় গরিবের মুক্তি। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করছে অ আ ক খ স্কুল। পুঁজিবাদী ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বিপরীতে তরুণদের এমন নিঃস্বার্থ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আর্থ সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষিত তরুণেরা এমন উদ্যোগ নিলে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে।’

নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘যে বিষয়টি বেশি তৃপ্তি দেয় তা হলো, যেসব ছেলেমেয়ে কিছুই লিখতে পড়তে জানতো না, তারা আজ স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়ছে। এখন তারা লিখতে, পড়তে পারছে। এই শিশুগুলো শিক্ষিত না হলে তারা একদিন দেশের বোঝায় পরিণত হবে। তারাই একদিন টোকাই হবে, মাস্তান হবে। আমি শিশু বিশেষজ্ঞ হতে চাই। শিশুদের নিয়ে কাজ করতে চাই, বিশেষত পথ শিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে। ইচ্ছা রয়েছে দেশের ৬৪ জেলায় স্কুলের শাখা পরিচালনা করার।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়