ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাবা তোমার কথা মনে পড়ে

পি. আর. প্ল্যাসিড || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ১৯ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবা তোমার কথা মনে পড়ে

বাবা চলে যাবার আগে অনেক কথা হয়েছে আমার। আমি দেশে সাধারণত কোনও না কোনও কাজ নিয়ে যাই। কাজের ফাঁকে দুই একদিন সময় করে বাবা-মার সাথে কাটালে বাবা খুব খুশি হতেন। খুব কাছে পেতে চাইতেন আমাকে।

বাবার শেষ সময়গুলো আমি বাবাকে অনেক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশে যখন ডাকাতি বেড়েছিল, তখন এই সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। আমি জানি, বাবার কথা এখন ইতিহাস, কখনও আমাকে মিথ্যে বলেননি।

আমি যেহেতু দেশের বাইরে থাকি তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সব কিছু নিজের মতো করে করা হয় না। তাই গত কয়েক বছর আগে স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে খুন হওয়া ফরহাদ খাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম আমার কিছু পরিকল্পনার কথা, যা বাবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ‘বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে খ্রিস্টানদের ভূমিকা’ লিখবো, কথাটি সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ খুন হবার পর দেশে বাংলা একাডেমিতে গিয়ে একজন কর্মকর্তার সাথে শেয়ার করেছিলাম। পরবর্তীতে দেখি সেই কাজটি অন‌্যভাবে করা হয়েছে।

এরপর একদিন আমি বাবাকে বললাম, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তো এই খ্রিস্টানরাও রয়েছে তাতে কি? ভালো কাজে যেমন খ্রিস্টানদের ভূমিকা রয়েছে খারাপ কাজেও রয়েছে। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ডাকাতিতেও যে এদের ভূমিকা রয়েছে সে কথাওতো মানুষের জানা দরকার। বাবা বেশ হেসে বলেছিলেন, তুই আমার বন্ধু হলি এমন সময় যখন আমি তোকে হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখিয়ে বলতে পারবো না। তারপর বাবা তো চলেই গেলেন। তবে অনেক কিছু জেনে রাখলাম বাবার কাছ থেকে।

বাবা আমার কাছে যত না আইডল তারচেয়ে বেশি মনে করতার তিনি আমার কাছে উইকিপিডিয়ার মতো। বাবা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। কিন্তু বাড়িতে সময় পেলেই তাকে দেখেছি বই, পত্রিকা পড়তে। আমি যখন কলেজের ছাত্র তখন দেখেছি, মাঝে মধ্যে গ্রাম থেকে ঢাকা আসলে আমার অবর্তমানে রুমে বিছানায় শুয়ে বা টেবিলে বসে ক্লাসের বিভিন্ন বই পড়তেন। এমন কি বাজার থেকে কোনও কিছু আনলে ঠোঙ্গাটা (কাগজের) সুন্দর করে খুলে তা বসে বসে পড়তেন তিনি।

বাবার ওপর একসময় আমার অনেক অভিমান ছিল। তারপরেও তার শখ পূরণ করতে আমি চেষ্টা করেছি লন্ডন, ইতালি, জাপান ঘুরে দেখাতে। আমরা ভাইবোন বিভিন্ন দেশে আছি বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। বাবা সেই ছোট সময় থেকে ভাওয়াল রাজার বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। বৃটিশ আমলে তার এক ভাই (বাড়ির) বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন, সেই দাপটেই সম্ভবত মাতব্বরী করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন বাবা। বাবার নাম মাথিয়াছ রিবেরু, এলাকায় মার্তুস মাতব্বর নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি।

কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় ভাদুন এলাকায় কোন এক সমস্যায় বাবাকে ডাকা হয়েছিল বিচার কাজে সমাধান দিতে। ফিরে এসে বাবা একদিন আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘বয়স হয়েছে তোর, মনে হয় প্রেম করিস। কিন্তু এমন কিছু করিস না যেন কোন মেয়ের বাবা আমাকে কিছু বলে, যাতে মাথা হেট হয়ে যায়’। আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, বাবা, কোন মেয়ের বাবা যদি কিছু বলতে চায় তাহলে আপনি বলবেন তার মেয়েকে যেন আমার সাথে দেখা না হয় সেই ব্যবস্থা করতে। তবেইতো আর কিছু বলার সুযোগ পাবে না।

বাবা হেসে বলেছিলেন, আমি জানি তুই তোর অন্য ভাইদের মতো হবি না। আমার বিশ্বাস আমার কথা চিন্তা করে হলেও এমন কিছু করবি না। তারপরও মাঝে মধ্যে মার কাছে বাবা আমার সম্পর্কে কিছু কথা বলতেন। পরে মা আমাকে তা বললে আমি বুঝিয়ে বলতাম মাকে, আসলে কেন কি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমন কথা রটেছে। যা আর পরবর্তীতে বাবা মা দুজনের কেউ এ নিয়ে ভাবেননি। তবে বাবা মারা যাবার আগে আমি অনেক কথাই শেয়ার করেছি বাবার সঙ্গে। আমার কথা শুনে বাবা খুব অবাক হয়েছিলেন আমি যে এতা কিছু জানি তা শুনে।

আমি বলছি না বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আবার এটাও বলছি না খুব খারাপ ছিলেন। তবে আমার জন্য বাবা সত্যিই একজন ভালো বাবা ছিলেন। যেহেতু শালিস করতেন, তাই মাতবর হিসেবে কেউ কেউ তাদের বিপক্ষে রায় গেলে তারা হয়তো খারাপ বলেছে। এর বাইরে বাবা কারো কোনও ক্ষতি করেছেন বলে আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি। শুনলেও তার কোনও প্রমাণ মিলেনি। বাবা হিসেবে তিনি আমাদের ভাই বোনদের মানুষ করতে ব্যর্থ ছিলেন এটি সত্য। সেই ব্যর্থতার কথাই বাবা আমার হাত ধরে শেষ সময় চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন অনেকবার।

বাবাকে নিয়ে লিখলে অল্প পরিসরে শেষ হবে না। আগেই ঠিক করে রেখেছি বাবাকে নিয়ে লিখবো। রাইজিংবিডির একটি বিজ্ঞাপন দেখে মন চাইলো আপাতত কিছু একটা লিখি। তাই এই লেখা।

আমি যেহেতু বাংলাদেশের ওপর জাপানের টেলিভিশন প্রোগ্রাম করার কাজে সহযোগিতা করি তাই ভেবেছিলাম বাবাকে নিয়ে টেলিফিল্ম নির্মাণ করবো যা পরবর্তীতে চেষ্টা করবো ডাবিং করে জাপানের কোনও একটি টিভি চ্যানেলে চালাবো। স্ক্রিপ  করিয়েছিলাম ভালো একজন নাট্যকারের মাধ্যমে, নাম দিয়েছিলাম ‘স্বাধীনতার গল্প’। পরবর্তীতে ভিন্ন লোকের পাল্লায় পরে সেই স্ক্রিপ্টে কাজ না করলেও স্বাধীনতার গল্প নামেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলাম। দুঃখের বিষয় আমি ভুল লোকের পাল্লায় পড়ে অনেকগুলো টাকা ইনভেস্ট করেও কাজটির কোন আর অগ্রগতি পেলাম না। টাকা গেলো। অথচ বাবার কোনও ফুটেজ পেলাম না।  

বাবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প বলছিলেন। পিছনে তা অভিনয় করিয়ে দেখানোর যে ব্যতিক্রম চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম বাবা নিজেও কাজটিতে অচল অবস্থায় থেকে খুব খুশি হয়েছিলেন আমার এমন উদ্যোগে। ইচ্ছে ছিল বাবাকে আমার কাজের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু অসাধু পরিচালকের পাল্লায় পড়ে পারিনি আমি বাবাকে আমার কাজে বাঁচিয়ে রাখতে। এরপর থেকে দেশে এই লাইনে যারা রয়েছে তাদের আর বিশ্বাস করতে পানি না।

বাবাকে মাঝে মধ্যে টেলিফোন করলে একটা কথাই বলতেন, তোকে আমি কিছু দিয়ে যেতে পারি নাই, তবে আশীর্বাদ করছি। আমার পুরো আশীর্বাদ তোর জন্য থাকবে। বাবার এমন কথা শুনে চোখের পানিই ফেলতাম কেবল। বাবা ভালো থাকা অবস্থায় আমার একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। বাড়ির পাশে তার এক খণ্ড জমি চেয়ে বলেছিলাম, আপনার অন্য কোথাও থেকে আমি জমি চাই না। বাড়ির সাথে লাগানো জমি আমাকে দিলে আমি এখানে একটি আশ্রম তৈরি করতে চাই।

বাড়ির পাশের এই জমিতে আমি জাপান আসার পর জাপানের টাকায় মাছ চাষের জন্য ছোট একটি পুকুর করেছিলাম। সে সময় ভেবেছিলাম আমি জাপান থেকে কয়েক বছর কাজ করে ফিরে গিয়ে গ্রামেই কিছু করবো। সেই পুকুরকে ঘিরে ছিল আমার তখন অন্যরকম পরিকল্পনা। বাবা আমার পরিকল্পনার কথা শুনে বলেছিলেন তিনি জীবিত থাকাকালেই লিখে নিতে। এটাও বলেছিলাম আপনার কোনও  সন্তান যদি আপত্তি করে তাহলে আপনার এই জমি আমার দরকার নেই। এই কথার কারণে বাবার সেই জমি আমার আর নেওয়া হয়নি। মারা যাবার পর মা বলেছিলেন জমিটা লিখে নিতে। আমি একা দান শর্তে জমি নেইনি। যদিও কয়েক বোন জমি আমার নামে এখনও লিখে দিতে রাজি আছেন।

বাবাকে নিয়ে আমার অনেক ইচ্ছে ছিল। জানি মানুষের সব ইচ্ছেপূরণ হয় না, বাবারও হয়নি। যেমন হবে না হয়তো আমারও। এটাই জীবন।

তবে একটা বিষয় আমি এখন খুশি, বাবা মা দুজনই বেঁচে থাকাকালে আমার সম্পর্কে অন্য ভাইবোনদের মতো তেমন কোনও অভিযোগের ভাষায় কথা বলতে পারেননি। উল্টো আরো বলেছেন আমাকে নিয়ে তাদের কখনও খারাপ কিছু শুনতে বা বলতে হয়নি। আমাকে নিয়ে তারা দুজনই গর্ব করেছেন। বাবা শেষ সময় একটি কথা বলেছিলেন, তুই যে এতা কিছু জানস আর এতো ভালো বোঝ আমি ভাবতেই  পারিনি। জানলে তোর হাতেই সব বুঝিয়ে দিয়ে মরতাম।

বাবার হাত দিয়ে বাংলাদেশে ক্যাথলিক চার্চের জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে। চাইলে নিজের জন্য হয়তো তখন অনেক কিছু করতে পারতেন, করেননি। আমরা যে কয়জন ভাইবোন তাদের কারোই সেদিকে নজর না থাকায় ঢাকায় বাড়ি করেননি। গ্রামের বাড়িতে যা কিছুই করে রেখে গেছেন তাও দেখার আগ্রহ আমাদের কারো নেই বলে হতাশ হয়ে বলতেন, আমি এত কষ্ট করেছি তোদের জন্য তোরা আমার সেই স্বপ্ন ধরে রাখতে পারলি না। কেউ এই জমি দেখে রাখছিস না।

বাবাকে ছোট সময় দেখেছি নিজের জমাজমি নিজে চাষ করতে। কখনও কখনও তার হালের পিছনে পিছনে হেঁটে সহযোগিতা করেছি। ছোট সময়কার বাবার অনেক স্মৃতি রয়েছে। বাবা বরাবর বলতেন, আমি দুইয়ানা রোজের কামলা খেটে এসব জমাজমি করেছি, এসব দেখে শুনে না রাখলে কি আর চলবে? এরপর যখন বড় হয়ে কলেজে ভর্তি হলাম তখন বলতেন, বাড়ির এসব জমাজমি নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি যেন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হই।

তবে একটা কথা সবসময় বলতেন, আমি কখনও যেন রাজনীতি এবং ওকালতি না করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা বাড়িঘর সব গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এই যন্ত্রণাতেই বাবা রাজনীতি করা পছন্দ করতেন না।

মারা যাবার সময় বাবার বয়স হয়েছিল সম্ভবত ৯৫ কিংবা ৯৭ বছর। বাবার জন্য চোখের পানি ফেলিনি, যদিও বুক ফেঁটে গেছে। বাবার আত্মার শান্তির জন্যই হাসি মুখে চেয়েছি তার বিদায়। বাবা যেখানেই থাকুন, তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক



ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়