ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দিনমজুরের কাজ করে ডাক্তার হচ্ছেন সোহাগ

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:২৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দিনমজুরের কাজ করে ডাক্তার হচ্ছেন সোহাগ

পুরস্কার নিচ্ছেন সোহাগ ছবি: অপু মোস্তফা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম। বাবা দিনমজুর। মা মারা গেছেন বিনা চিকিৎসায়। ঘরে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা নেই। এমন পরিবারে পড়াশোনার চিন্তা করাটাই যেন অন্যায়! হলোও তাই। টাকার অভাবে পড়াশোনা এক সময় বন্ধ হয়ে গেল। বাবার মতো শুরু হলো অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ। একদিন ডাক্তার হয়ে আর কোনো মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে না দেয়ার স্বপ্নটা থেমে গেল ওখানেই।

না। থেমে যাননি সোহাগ হাওলাদার। দিন মজুরের কাজ করেও এখন সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। গোপালগঞ্জের সীতাইকুণ্ড গ্রামের ছেলে সোহাগ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে শৈশব। বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করা, রাতে মাছ ধরতে যাওয়াই ছিল আমার প্রতিদিনের কাজ। আর দশটা ছেলের মতো বিকেলে খেলাধুলা করার সময় হয়নি কখনো। কীভাবে দিনের খাবার জুটবে এই ছিল এক সময় জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তবুও মনের মধ্যে একটা জেদ কাজ করত, পড়াশোনা আমাকে করতেই হবে, বড় হতেই হবে। তাই সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতে হারিকেনের আলোয় যখন পড়তে বসতাম ক্লান্ত শরীর সায় না দিলেও মনের জোরে পড়তাম।’

সোহাগ যখন ক্লাস ফোরে, তখন মা মারা যান। সোহাগ বলেন, ‘সেদিন মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারিনি। মা কি রোগে মারা গেলেন জানতেও পারিনি। মেডিকেলে পড়ে এখন বুঝতে পারছি মা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিলেন।’ সোহাগ ক্লাস ফোরে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে, বাড়ির সিদ্ধান্তে পড়াশোনা বন্ধ করে নারায়ণগঞ্জে একটি ওয়ার্কশপে কাজ নেন। সেখানে সকাল ৮টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কাজ করতে করতে সোহাগ যখন দেখতেন কারখানার সামনে দিয়ে তার বয়সের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে তখন কান্না লুকিয়ে রাখতে পারতেন না। কিন্তু এই কান্না তার মনোবল ভেঙে দেয়নি। উল্টো তাকে মানসিকভাবে শক্ত করেছে।

সোহাগ দৃঢ় মনোবল নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, পুনরায় পড়াশোনা করবেন। ছয় মাসের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলেন তিনি। তার এই সিদ্ধান্তে পরিবারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ততদিনে সংসারে সৎ মা এসেছে। তিনি সোহাগকে আবার ওয়ার্কশপে কাজে পাঠাতে চাইলেন। সোহাগ বেঁকে বসলেন। ফলে বাড়িতে থাকার জায়গা হলো না। নিরুপায় হয়ে সোহাগ পাশের বাড়িতে লজিং থেকে আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হলেন। ভর্তি হলেন ক্লাস ফাইভে। লজিং থাকার কারণে থাকা-খাওয়া জুটত। কিন্তু পড়াশোনার খরচ? প্রতি শুক্রবার অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ নিলেন সোহাগ।

সোহাগ বলেন, ‘বৃত্তি পরীক্ষার গাইড কেনার জন্য বাড়ির এক চাকরিজীবীর কাছে টাকা চেয়েছিলাম, তার তাচ্ছিল্যের হাসি এখনো চোখে ভাসে। যে সারাদিন মাঠে কাজ করে সে করবে পড়াশোনা? জেদ চেপে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে পড়তে থাকি। পরে ৫০ টাকা দিয়ে এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পুরনো একটি বৃত্তির গাইড কিনেছিলাম।’
 


রাফ খাতা কেনার টাকা ছিল না সোহাগের। তাই পুরনো খাতার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সে লিখত না। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সবাইকে চমকে দিয়ে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সোহাগ। এটি ছিল তার ছাত্রজীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর টিউশনি করে পড়াশোনা করেছেন সোহাগ। তার স্কুলজীবন কেটেছে পুরোপুরি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বিভিন্ন সময় ছয়টি বাড়িতে লজিং থেকে। কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগ হয়নি, উল্টো ক্লাসের বন্ধুরা তার কাছে প্রাইভেট পড়েছে।

এবার উচ্চশিক্ষার পালা, ডাক্তার হবার স্বপ্ন। ঢাকা আসার পর হাতে কোনো টাকা নেই। সোহাগ দৈনিক ১৫০ টাকা চুক্তিতে চাকরির বিজ্ঞপ্তির পোস্টার লাগানোর কাজ নেন। কোচিং করার সামর্থ্য ছিল না, তাই বলে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। তারপরও প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও মেডিকেলে হলো না। হাল ছাড়লেন না তিনি। দ্বিতীয় বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন। এবার সমস্যা হলো, পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা নেই। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিলেন। দিলেন পরীক্ষা। রেজাল্টে জানা গেল তিনি ১৮২তম হয়ে ঢাকা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।

সোহাগের জীবনে এর পরের গল্প অতটা সংগ্রামী নয়। কারণ ততদিনে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। অন্যদিকে অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তা হিসেবেও সোহাগ পরিচিত হয়ে উঠেছেন ক্যাম্পাসে। সম্প্রতি স্টামফোর্ড মাদকবিরোধী ফোরাম অদম্য তরুণ হিসেবে সোহাগ হাওলাদারকে সম্মাননা প্রদান করেছে।

সোহাগ এখন নিজ গ্রামে অনুসরণীয় তরুণ। যে গ্রামে পড়ালেখার বালাই ছিল না, সেখানে আজ অভিভাবকেরা অনেক বেশি সচেতন সন্তানদের পড়াশোনার জন্য। সোহাগ বলেন, ‘গ্রামের যে মানুষগুলো আমাকে তাচ্ছিল্য করত, তারাই আমাকে এখন অনেক গুরুত্ব দেয়। সন্তানের শিক্ষার জন্য আমার পরামর্শ নেয়। গ্রামের সবার যে কোনো সমস্যায় আমার ডাক পড়ে। মনে অন্যরকম এক প্রশান্তি আসে। আমি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, একদিন সেই ওয়ার্কশপের মালিক ঢাকা মেডিকেলে এসে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি তাকে ডাক্তার দেখাতে সাহায্য করেছিলাম।’

ভবিষ্যতে চিকিৎসা শাস্ত্রে বিদেশ থেকে উচ্চতর শিক্ষা নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন সোহাগ। তার স্বপ্ন মায়ের নামে হাসপাতাল নির্মাণ করা। সোহাগ হাওলাদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। আমি চাই না, আর কোন মা বিনা চিকিৎসায় মারা যাক।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়