ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

আশা-নিরাশার দোলাচলে ঢালচর

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আশা-নিরাশার দোলাচলে ঢালচর

রফিকুল ইসলাম মন্টু, ভোলার চরফ্যাশনের ঢালচর ঘুরে: সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ক্ষতিগ্রস্থ দ্বীপগুলোর মধ্যে ঢালচর অন্যতম। ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে বিরাণ জনপদে পরিণত হয়েছিল সম্ভাবনাময়ী এই দ্বীপ। ৫০-৬০টি পরিবারের মধ্যে টিকেছিল মাত্র ১২-১৩টি পরিবার। মানুষজন, ঘরবাড়ি, গাছপালা, গবাদি পশু সবকিছু ভেসে যায়। এরপর থেকে আবার কোলাহল বাড়তে থাকে ঢালচরে। বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি নিয়ে দ্বীপে বাড়ে মানুষের আগমন।

কিন্তু ৫০ বছর হতে না হতে সেই দ্বীপ আবারও হুমকির মুখে। তবুও মানুষ বুক বাঁধে। আবার হয়তো ফিরবে সুদিন। ভাঙন রোধ হয়ে আবার হয়তো বিকাশের ধারায় এগোবে এই ঢালচর। এভাবেই প্রকৃতির নিয়মে আশা-নিরাশার দোলাচলে সময় পার করছেন ঢালচরের মানুষেরা।

ঢালচরের একজন বয়সী বাসিন্দা মোফাজ্জেল হোসেন। এখন বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। মূল বাড়ি ছিল ভোলার বোরহানউদ্দিনে। ঢালচরে আসেন সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের আগে। ভূমিহীন পরিবার হিসাবে এরশাদ সরকারের সময় মাত্র ২ একর খাসজমি বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তখন এখানকার বাসিন্দারা বন কেটে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বসতি গড়েন। তিনি জানালেন, তখন এখানে খুব বেশি বসতি ছিল না। ৫০-৬০ পরিবার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে এখানে বসতি শুরু করে।

মোফাজ্জেল হোসেন জানান, হাজারো সংকটেও সম্ভাবনার আশায় বুক বাঁধি। হয়তো ঢালচরে আবার ফিরবে সুদিন। দুর্যোগ-দুর্বিপাক আমাদের পিছু ছাড়ে না; তবুও চরেই থাকতে হয়। তিনি বলেন, সরকার থেকে পাওয়া ২ একর জমির সঙ্গে আরও তিন একর জমি কিনতে পেরেছিলাম। ২০১৭ সালের জুলাই-আগষ্টের দিকে সে জমির পুরোটাই নদীগর্ভে চলে যায়। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শপাড়ায় ছিল মোফাজ্জেল হোসেনের প্রথম বাড়ি। এখন বাড়ি করেছেন ২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজীপুরে। মাত্র ১৬ শতাংশ জমি কিনেছেন ৫০ হাজার টাকায়। এই জমির নিকটেও ভাঙন পৌঁছে গেছে।
 


’৭৪ সালের দিকে ঢালচরে আসেন মাস্টার আনিসুর রহমান। একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনি জানালেন, গোটা চর তখন হেলিপাতা, হোগল পাতা, ভেলুয়াপাতা, নল, গুজিকাঁটা, হাড়গুজিকাঁটা, কাইল্যা লতাসহ ঝোপঝাড়ে পরিপূর্র্ণ ছিল। সেগুলো কেটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বসবাসের জায়গা করা হতো। ওই সময় আনিসুর রহমানসহ আরও ১৩টি পরিবার এখানে আসেন। এদের কেউ এখানে আছেন, কেউ আবার চলে গেছেন অন্যত্র। তিনি জানান, কষ্ট করে থাকলেও এখানকার মানুষগুলো আশা নিয়ে বাঁচে; হয়তো আবারও সম্ভাবনাময় সেই দিন আসবে।

দ্বীপের নামকরণের ক্ষেত্রে ‘ঢালু চর’ কিংবা ‘ঢালের মত চর’, দু’ধরনের কথাই প্রচলিত আছে। বয়সী ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে তৎকালীন সার্ভেয়ার মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে চরে জরিপ পরিচালিত হয়। তখন তিনি চরটিকে ঢালের আকৃতিতে দেখতে পান। সেই থেকে চরের নাম হয় ঢাল চর। আবার কেউ কেউ জানিয়েছেন, চরটির চারদিক ঢালু ছিল বলে এর নামকরণ হয়েছে ঢালচর। এই চরের পুরনো নাম চর সত্যেন। কথিত আছে, এক সময় এখানকার মানুষ খুবই ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদী ছিলেন। মালামাল পড়ে থাকলেও কেউ চুরি করতো না। অনেকে মনে করতেন এখানে অলি আউলিয়াদের আনাগোনা আছে। এই সত্যবাদিতার ‘সত্য’ কালের বিবর্তনে ‘সত্যেন’ রূপ ধারণ করে নামকরণ হয়েছিল চর সত্যেন। 

সূত্র বলছে, ৮২-৮৩ সালের জরিপের ভিত্তিতে বন এলাকা ছাড়া ঢালচরের পরিধি ১৭০০ একরের বেশি ছিল। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে চরে আরেকটি জরিপে দেখা যায়, বন এলাকা ছাড়া চরের পরিধি ১২৫০ একর। বর্তমানে এর পরিমাণ ৭০০ একরে নেমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ১৯৯৭-৭৬ সালের দিকে ঢালচরে বনায়ন শুরু হয়; যা বনের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত।   
     


নদী-সমুদ্রে মাছ আহরণ, কৃষি কাজ আর গবাদিপশু লালন পালন ঢালচরের মানুষের প্রধান জীবিকা। লোকসংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার পাঁচশ হলেও ভোটার সংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদারও এই দ্বীপ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আবারও এই দ্বীপকে সম্ভাবনার স্থানে ফিরিয়ে নিতে চান তিনি। দ্বীপের কেন্দ্র বলে পরিচিত হাওলাদার বাজারে একটি ভাড়া টিনশেড ঘরে পরিচালিত হয় ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। সেখানেই আলাপ তার সাথে। ঘরটির এককোণে চেয়ারম্যানের দপ্তর। সন্ধ্যার পর সেখানে বিভিন্ন কাজে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ঘরটির একপাশে রয়েছে গ্রাম আদালত। এবং অন্যপাশে ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের কার্যক্রম চলে।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানালেন, দ্বীপের মানুষ রয়েছে হাজারো সংকটে। তবুও তারা আশায় বাঁচে। শুকনো মৌসুমে মানুষের হাতে তেমন টাকা-পয়সা না থাকলেও বর্ষায় জমজমাট ব্যবসাবাণিজ্য চলে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আসা হাজার হাজার ট্রলার ভেড়ে ঢালচরের বিভিন্ন ঘাটে। বর্ষাকালে এখানকার বাজারগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটে। এখান থেকে মোটা অংকের রাজস্ব যায় সরকারের খাতে। এখানে রয়েছে একাধিক মনোরম সমুদ্র সৈকত। সুতরাং ঢালচরের সম্ভাবনা বিকাশের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। শুধু সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।       

প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় ঢালচরকে ইউনিয়নের মর্যাদা দেয়া হয় ২০১০ সালে। এর লক্ষ্য ছিল বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম ঢালচরের মানুষের জন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। কিন্তু দ্বীপ ইউনিয়নের সমস্যা অনুপাতে বিশেষ বরাদ্দ যেমন দেওয়া হচ্ছে না; তেমনি আবার পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনায় এখনও অবকাঠামোগত সহায়তা পায়নি পরিষদ। পরিষদের জন্য আধুনিক ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, শুরু হয়েছে কাজ। কিন্তু প্রায় ৬ বছরেও ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ছে, পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের কাজও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

ঢালচরের একমাত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রটি নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়ায় এখানে দুর্যোগে আশ্রয় নেওয়ার মত কোন স্থান নেই। ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য দুর্যোগে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের কথা বিবেচনায় রেখে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১০ সালের নভেম্বরে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবন নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ভবন হস্তান্তর করা হয়নি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়