ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাঙলার বাবু সংস্কৃতি

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঙলার বাবু সংস্কৃতি

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী : বাঙলার বাবু সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এই সংস্কৃতির পূর্ববর্তী সময়ে এই অঞ্চলের রাজনীতি এবং সংস্কৃতির দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। যার পথ বেয়ে বাঙলা অঞ্চলে বাবু সংস্কৃতির পথচলা। কলকাতাকেন্দ্রিক এই বাবু সংস্কৃতির মূলে ছিল মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তর আর তারও পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন।

বাঙালি সংস্কৃতি এই জনপদের জীবন-জীবিকা, ভূমি, রাজনীতি, অর্থনীতির আলোকে অনুসন্ধান করা যায়। বাংলাদেশে নানা সময়ে শাসকেরা এসেছে। বাঙলা অঞ্চল ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত। এখানে উর্বর জমি আর প্রযুক্তির লোভে সাম্রাজ্যলোভী আর বণিকেরা এসেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, মিশরের মমি বাংলাদেশের মসলিনে আবৃত করা হতো। এই তথ্য আমাদের অনুমান করতে সাহায্য করে, আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল বাংলার। নৌ-বাণিজ্যের সূত্রে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেকেই এদেশে এসেছে। তারা চেয়েছে বাঙলা শাসন করতে। কতক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে।

পৃথিবীর সর্বত্র শাসক নিজের সংস্কৃতি শাসিতের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেয়। প্রাচীন বাংলায় আর্যরা এসেছে, অনার্যদের তারা নিম্নশ্রেণির ভেবে চাপিয়ে দিয়েছে আপন সংস্কৃতি। আবার মুসলমান শাসকেরা এসেছে; তারা এখানে সমন্বয়বাদী শাসন পদ্ধতি প্রচলনের প্রয়াস নিয়েছে। তারা এখানে বহিরাগত শাসক ছিলেন তাই স্থানীয় সমর্থন আদায় করা ছিল তাদের লক্ষ্য। তাই তারা শাসনের ক্ষেত্রে নিজেরা শাসিতের জীবন ও সংস্কৃতি উপলব্ধি করতে চেয়েছে।

মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে এ দেশে মুসলমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পায়। এ সময় থেকে ক্রমাগত অব্যাহত গতিতে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, আফগানিস্তান, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে অসংখ্য মুসলমান জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাংলায় আগমন করতে থাকেন। অধিকাংশ এসেছিলেন সৈনিক হিসেবে, অবশিষ্টাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলাম প্রচার ও আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে। এভাবে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা হয়ে পড়ছিল ক্রমবর্ধমান। বাংলায় স্বাধীন সুলতানরা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। প্রায় তিন শতাব্দীর বেশি সময় ধরে টিকে থাকা সুলতানি আমল ইতিহাসের অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেশ ছেড়ে বিদেশেও সুনাম কুড়িয়ে ছিল। মূলত সুলতানি আমল থেকেই বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতি চালু হয়। এ সময় ঘটে বাংলা কথাসাহিত্যের বিকাশ। সুলতান রোকন-উদ-দীন বারবাক শাহ-এর আমলে কৃত্তিবাস সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। সুলতানি আমলে বাংলায় শাসন ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট মজবুত। দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল; আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির কারণেই এমন অবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের উর্বর ভূমি এদেশের কৃষিজীবীদের ফসল উৎপাদনের পথ তৈরি করেছে। ধান উৎপাদন করা যেতো অতি সহজেই। সুলতানি আমলে প্রচুর ইক্ষু চাষও হতো। আখের রস থেকে গুড় ও চিনি তৈরির পর বিদেশে রফতানি করা হতো। বাংলাদেশে বড়ো বড়ো সমুদ্রগামী কাঠের নৌকা নির্মাণের ইতিহাসও পাওয়া যায়। যার কারণে বাংলাদেশ হয় বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু।

প্রচুর রেশম উৎপন্ন হয়ে বিক্রি হতো বিদেশের বাজারে। সুলতানি আমলে চীন থেকে এসেছিলেন মা হুয়াং নামে একজন চীনা পর্যটক। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে লিখেছেন: ‘রেশম উৎপাদনের জন্য এ দেশে যত্ন করে তুঁতগাছ লাগানো হয়।’ বাংলাদেশের রাজ্য ব্যবস্থায় সুলতানের ছেলে সাধারণত সুলতান হতেন। কিন্তু কাউকে সুলতান হতে হলে প্রয়োজন হতো আমির ও অন্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সমর্থন। তাদের সমর্থন ছাড়া কেউ সুলতান হতে পারতো না। সুলতানের ছেলে না হয়েও বাংলাদেশে সুলতান হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। বাংলার বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ছিলেন উচ্চ রাজকর্মচারী কর্তৃক নির্বাচিত সুলতান। তার পুত্র নাসির উদ্দীন নুসরাত শাহ সুলতান হওয়ার সময় উচ্চ রাজকর্মচারীদের সাধারণ অনুমোদন লেগেছিল। বোঝা যায় বাঙলা অঞ্চলে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা শক্তিশালী ছিল। সুলতানি আমলে সেনাবাহিনী ছিল চার ভাগে বিভক্ত- অশ্বারোহী, গজারোহী, পদাতিক ও নৌবহর। পদাতিক সৈন্যদের বলা হতো ‘পাইক’। দশজন অশ্বারোহী নিয়ে একটি দল গঠিত হতো। যাকে বলা হতো ‘খেল’। খেলের প্রধানকে বলা হতো ‘সর-ই-খেল’। বাংলার নৌ-বহরের অধিনায়ককে বলা হতো মীর-বহর। বাংলার গজবাহিনী বা হস্তিবাহিনী আলেকজান্ডারের সময় থেকে বেশ বিখ্যাত ছিল। সৈন্যবাহিনীর বেতনদাতার উপাধি ছিল উজির-ই-লস্কর। বাংলার সৈন্যরা পর্তুগিজদের কাছে কামান চালাতে শিখেছিল। তারা বাবরের সাথে যুদ্ধের সময় কামানের ব্যবহার করেছিলেন। বাবর বাংলা জয় করতে পারেননি। নুসরাত শাহের সাথে সন্ধি করেছিলেন। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে নুসরাত শাহের প্রশংসা করেছেন। বাবর নুসরাত শাহকে বলেছেন ‘বাঙালি’। এর আগে কোনো সুলতানের নামের পর কেউ বাঙালি কথাটা যোগ করেননি। খাজনা আদায়ের অঞ্চলকে বলা হতো ‘মহল’। কয়েকটি মহল নিয়ে গঠিত হতো শিক। শিকের কর্তাকে বলা হতো শিকদার। সেখান থেকেই ‘শিকদার’ উপাধির প্রচলন হয়েছে, যা এখনো দেখা যায়। এ সময়ে বাঙলা অঞ্চলে রাজকর্মচারী, কৃষক, বণিক, ভূস্বামী প্রভৃতি শ্রেণি নিজ অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। একই সঙ্গে শাসকের সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির কারণে বড়ো কোনো নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাস পাওয়া যায় না।

নবাবী আমলের বাঙলাকে একটু চিনিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বাঙলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁর সময়ে মুর্শিদাবাদে নানা উৎসব আয়োজন হতো- এ থেকে অনুমান করা যায় বাঙলা অঞ্চল অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কতটা শক্তিশালী ছিল। তাঁর সময়ে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে পূন্যাহ আয়োজিত হতো। জমিদার আর তাদের কর্মচারীরা এই উৎসবে যোগ দিতে নগরে আসতেন। তবে সব উৎসব ছাপিয়ে উঠতো মৌলুদ। ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষ্যে এই আয়োজন করা হয়। এ সময়ে অন্য রাজ্য থেকে লোকজন এই উৎসবে যোগ দিতে আসতো। উৎসবের বড়ো সৌন্দর্য- মসজিদ আর ইমামবাড়ায় চেরাগ বা বাতি জ্বালানোর রেওয়াজ। তাঁর দরবারে ব্যবসায়ী, বিদেশি ভ্রমণকারী, কোম্পানির প্রতিনিধি এবং ব্যাংকাররাও থাকতেন। একই সময়ে বাণিজ্যের বিকাশের ফলে নতুন এক ব্যবসায়ী শ্রেণির উদ্ভব হয়, তারাও রাজদরবারে ঠাঁই করে নেয়। তিনি খাজনা আদায়ের জন্য হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন, তাঁর ধারণা ছিল এ কাজে হিন্দুরা সাফল্যের পরিচয় দিতে পারবে। একই সঙ্গে ফার্সি ভাষায় হিন্দুরা পারদর্শী ছিল। এরপর বাঙলা শাসন করেন সুজাউদ্দিন খান, তিনিও একটি সমৃদ্ধশালী দেশ রেখে যান। পরবর্তী সময়ে নবাব আলীবর্দী খান আফগান বিদ্রোহ দমন এবং মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করে বাঙলার জনগণকে রক্ষা করেন। মারাঠা আক্রমণের ফলে পশ্চিম বাংলায় প্রজাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল; যার ফলে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অবনতি ঘটে। মারাঠাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর নবাবের উৎসাহ এবং শাসনব্যবস্থার কারণে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত উন্নতি হয়, বাঙলা আবার ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে। তাঁর শাসনামলে বহু হিন্দু উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আলীবর্দীর শাসনামলে ফার্সি সাহিত্য প্রসার লাভ করে। তিনি শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। তাঁর শাসনামলে বাঙলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বিস্তৃতি লাভ করেছিল।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বাঙলা অঞ্চলে ভারতীয়দের শাসনের অবসান হয়। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা ইংরেজরা এদেশে শাসনের চেয়ে সম্পদ লুণ্ঠনে মনোযোগী ছিল। যা বাঙলা অঞ্চলে নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণির উত্থানকে এগিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজ শাসন চালু হবার পর ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়। যারা ইংরেজ আমলে যত্রতত্র ‘বাবু’ বনে গেলেন। বাবু বিষয়ে একটি কথা লিখে রাখা যায়, ‘বাবু’ ছিল নবাবদের দেওয়া উপাধি, শিক্ষিত ও ধনীদের এই উপাধি দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসনের সময়ে বিত্তবানরা বাবু হওয়ার লড়াইয়ে নামলেন। ইংরেজদের চাকরি বা সেবা করে অনেকই নিজের অবস্থা ফিরিয়ে আনে। তারা কুকুরের বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করে, চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান করতে যায়। কতো জাতের ঘোড়া যে গাড়ি টানতো তা শুধু ঘোড়া রক্ষকরাই জানতেন। এটা নিয়েও প্রতিযোগিতা ছিল বাবুদের মাঝে। স্নানের সাবান আসতো ইউরোপ থেকে, সেসব সাবানের আবার বাহারি নামও ছিল। তাদের কোনো কোনো রাত রক্ষিতা ছাড়া রঙিন হতো না। রক্ষিতাদের দালানকোঠা করে দেওয়া, পায়রা ওড়ানো, বিদ্যাসুন্দরের আসর বসানো ইত্যাদি ছিল তৎকালীন কলকাতার সংস্কৃতি। ভুলে গেলে চলবে না কলকাতার বাবু সংস্কৃতির মূল উপাদান ছিল- বাঈজি বা গণিকাকে নিজের করায়ত্ত্ব করে নেওয়া। তবে যাকে তাকে নয়, সবচেয়ে খ্যাতিমান বাঈজিকে অন্য কারো কাছ থেকে তুলে আনার মধ্যে ছিল সেরা বাবু হওয়ার পথ।



কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে বাঁদরের বিয়েতে এক লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। বানরের মাথায় মুকুট পরিয়ে সে বিয়ের আয়োজন করা হয়। প্রিয় পাঠক একবার ভেবে দেখুন মুকুট পরে পালকিতে চড়ে বানর যাচ্ছে আর তার পিছন পিছন একদল বাঈজি গান গাইতে গাইতে সঙ্গী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, রাজা ইন্দ্র নারায়ণ সিংহের বেড়ালের বিয়ের কথা। নিমাইচাঁদ মল্লিকের নাতি রামরতনের বিয়েতে চিৎপুরের রাস্তা গোলাপ জলে ভেজানো হয়েছিল। তবে সে রাস্তার দূরত্ব ছিল দুই মাইল। এখানে তাজা গোলাপে কতো ব্যয় হয়েছিল সে কথা নাইবা হলো বলা। শিবনাথ শাস্ত্রী এই শ্রেণি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাবু মহাশয়েরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এস্রাজ, বীণা প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রিকালে বারাঙ্গণাদিগের গৃহে গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদ-প্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গণাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইতেন।’

প্রিয় পাঠক হঠাৎ টাকা হাতে আসা এই বাবুদের কথা একবার ভেবে দেখুন। জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে, কবজিতে বেলফুলের মালা জড়িয়ে, গায়ে আতর মেখে, গিলে-করা পাঞ্জাবি আর চুনট-করা ধূতি পরে নামতেন বাঈজিগানের ঘরে। দেদার উড়ত গরিবের কাছ থেকে শোষণ করে নেওয়া টাকা। থাকত বিস্তর মদ-মাংস। কতো রাত তাঁরা এই আসরে কাটিয়ে দিয়েছেন সে হিসাব জানতেন স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত তাঁদের স্ত্রীরা।

কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা থেকে জানা যায়, তারা রাত্রে নিজ বিবাহিতা স্ত্রীর মুখ দেখতেন না। বাড়ির প্রধান আমলা, দারোয়ান, মুৎসুদ্দিরা যেমন হুজুরের বিষয়কর্ম দেখেন স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাঁদের উপর বর্তায়। সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন? এই ভয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ির ভিতর ঘরে পুরে চাবি বন্ধ করে রাতভর বেশ্যা নিয়ে ফুর্তি করে সকালে বাড়ি ফেরেন। এ থেকেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এবার সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দিকে হাত বাড়াই। তাঁর ‘বাবু’ শিরোনামের রম্যরচনায় লিখেছেন, ‘যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।’

কলকাতার খ্যাতিমান বাবুদের মধ্যে ছিলেন, কালীপ্রসন্ন সিংহের পূর্বপুরুষ ছাতু সিংহ। তিনি কলকাতার বাবু সংস্কৃতির প্রথম দিকের পুরুষ। এদের ঐতিহ্য নিয়ে সেকালে যে নানা রঙ্গ রসিকতা প্রচলিত ছিল, সে কথা বলা যায় অনায়াসেই। নতুন জমিদারদের সম্পর্কে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, ‘ক্ষুদ্র নবাব, ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে দুধে আলতার মতো রং,আলবার্ট ফ্যাশানে চুল ফেরানো, চীনের শূয়রের মতো শরীরটি ঘাড়ে-গদ্দানে, হাতে লাল রুমাল ও পিচের ইস্টিক, সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজারাজড়ার পৌত্তর; কিন্তু পরিচয়ে বেরোবে হৃদে জোলার নাতি!’

বাবুরা বাঙলার বিভিন্ন স্থান থেকে কলকাতায় এসে আমোদ ফুর্তি করতেন, তাদের কয়েকজন মোসাহেবও জুটে যেত। বাবুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বখশিশ পেতেন। এরা সারাক্ষণই বাবুর প্রশংসা আর অন্যদের কুৎসায় ব্যস্ত থাকতো। বাবুরা এদের হাতের পুতুল হয়ে সব টাকা খুইয়ে ফেলতেন। তারপর নিজের জমিদারিতে গিয়ে খাজনা আদায় করে আবার কলকাতার পথ ধরতেন। কেউ কেউ আবার ব্যবসা বাণিজ্য করে কলকাতায় স্থায়ী আবাস গড়েছিলেন।

বাবু সংস্কৃতি যে কলকাতায় বিপুল বিস্তারী প্রভাব ফেলেছিল সে কথা বলা চলে নিঃসন্দেহে। এ বিষয়ে একটি প্রবচন উল্লেখ করা হলো:

জাল জুয়াচুরি মিথ্যা কথা

এই তিন নিয়ে কলকাতা।

বাঙালির এই বাবু সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। সেটা নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা লেখা যেতে পারে। তবে বলা যায়, বাবু সংস্কৃতির পথ বেয়েই ভদ্রলোকের সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়