ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জাতীয় ফুলে জীবন চলে

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৪, ৭ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় ফুলে জীবন চলে

খায়রুল বাশার আশিক : খুব সকাল থেকে শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে একসঙ্গে। পরিবারের কর্তা বৈঠা চালায় বিলের পানিতে, চলমান নৌকায় বসে পুত্র টেনে টেনে নৌকায় তোলে শাপলা। সেই পরিবারের গিন্নি আর কন্যা শাপলাগুলো গুছিয়ে আঁটি বাঁধে পাড়ে বসে। সকালের আলোর তীব্রতা বাড়ার আগেই শাপলাগুলো নিয়ে হাটে যেতে হয়। এই শাপলাগুলো বিক্রি করে চলে পরিবারের জীবিকা। এমন শতাধিক পরিবারের জীবিকা হয়ে উঠেছে বরিশাল উজিরপুরের একাধিক ছোট-বড় শাপলার বিল। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলায় জল্লা ইউনিয়নের কারফা, সাতলা, হারতা, বাগদা, পশ্চিম কালবিলাসহ ৮ থেকে ১০টি গ্রামের প্রায় ১০০ পরিবারের জীবিকার উৎস শাপলা সংগ্রহ এবং বিক্রি। এ অঞ্চলে ছোট-বড় প্রায় ২০টি বিল রয়েছে, যেখানে বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয় অসংখ্য শাপলা ফুল।

শাপলা জাতীয় ফুল, অনেক ঔষধি গুণ আছে এই ফুলে। শাপলা ফুলের ঠিক নিচ থেকে মূল অবধি লতা সবজি হিসেবে রান্না হয়। খেতে সুস্বাদু হবার কারণে এই সবজির ব্যাপক চাহিদাও আছে বাজারে। এখানকার শাপলার কোনো উৎপাদন খরচ নেই বলে খুব সস্তায় বিক্রি হয়। উজিরপুর, ধামুরা, আগোলঝাড়া ও তার আশেপাশের স্থানীয় বাজারে প্রতিটি শাপলার আঁটি বিক্রি হয় ৮ থেকে ১০ টাকায়। এ অঞ্চলের অনেক সবজি বিক্রেতা এই শাপলাগুলো পাইকারি দরে কিনে দূরবর্তী বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। সেক্ষেত্রে পরিবহন খরচ থাকায় দাম বেড়ে আঁটি প্রতি বিক্রি হয় ১২-১৫ টাকা পর্যন্ত। প্রতিটি আঁটিতে শাপলা থাকে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি।

জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস এ অঞ্চলের বিলগুলোতে পানি জমে থাকে। ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক এই তিন মাস এ অঞ্চলের বিলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শাপলা জন্ম নেয় প্রাকৃতিকভাবে। বছরের এই সময়টাতে প্রকৃতি প্রদত্ত শাপলা ফুল যেন হাজারো মানুষের জীবিকার যোগান দিতেই জন্ম নেয়। এই জনপদে শাপলা ফোটে অনেকের আশীর্বাদ হয়ে। ফলে শাপলা ফূল স্থানীয় অনেকের কাছে ‘ভগবানের পক্ষ থেকে দেয়া উপহার’ বলে মনে হয়। উল্লেখ্য স্থানীয়দের সিংহভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী।

স্থানীয় কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানালেন, বছরের ছয় মাস এখানকার অধিকাংশ বিলে পানি আটকে থাকে। ফলে বিলগুলো এক ফসলা জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর পানি শুকিয়ে গেলে জমিতে চাষ দেয়া হলেও মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে শাপলা-শালুকের বীজ। এই বীজগুলো থেকেই পরের বছর পানি এলে জন্ম নেয় শাপলা।



এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিল সাতলা। প্রচুর শাপলা জন্মানোর কারণে গ্রাম ও বিলের নাম হয়েছে সাতলা। প্রতিদিন এই বিলে কত শাপলা ফোটে তা গুনে দেখার সাধ্য নেই কারো। অসংখ্য শাপলা সমৃদ্ধ সাতলার বিল এখন সমগ্র বরিশালের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাতলা গ্রামের শত শত মানুষ হাটে বাজারে শাপলা বিক্রি করে তাদের পেটের খোরাকের যোগান দিচ্ছে। সাতলা ও বাগদা গ্রামের প্রায় ৬-৭টি গ্রামীণ দরিদ্র কৃষিনির্ভর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার প্রায় ১০০টি দরিদ্র কৃষক পরিবার শাপলার এই মৌসুমে শাপলা তোলা ও বিক্রির কাজে জড়িয়ে পড়ে। কৃষক পরিবার ও কৃষিজীবীদের হাতে এ সময় কৃষি কাজ না থাকায় তারা শাপলানির্ভর হয়ে ওঠে। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম বিক্রি করা ভূমিহীন পরিবারগুলোও আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে শাপলা ব্যবহার করে। 

মাথায় শাপলা নিয়ে হাটে যাচ্ছিলেন হারুন মিয়া (৬০)। তিনি ফুল বিক্রি করে সংসারের প্রয়োজনীয় সদাইপাতি কিনবেন। ছেলে বায়না ধরেছে ক্রিকেট বল কিনে দিতে হবে- বলও কিনবেন বলে জানালেন। চার ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীর মুখে শাপলা বিক্রি করে এভাবেই প্রতিদিন খাবার তুলে দেন হারুন মিয়া। আগামীকাল আবার তিনি খুব সকালে শাপলা তুলবেন, হাটে আসবেন নতুন একটা স্বপ্ন বুকে নিয়ে। ছবি তুলতে চাইলে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। ছবি তোলা শেষে যেতে যেতে কথা বলার ক্ষণে ছলছল চোখে বলে উঠলেন, ‘ক্ষেতে কোলার কাম নাই এহন, বিলে শাপলা ফোডে বইলা চুলার পাহায় পাইলা ওডে (পরিবারে রান্না হয়), নইলে না খাইয়া থাহোন (থাকা) লাগতো। এই শাপলাই আমাগো সম্বল, শাপলা আমাগো মতো গরিবের প্যাডের (পেটের) ভাত যোগায়।’

পড়ুন :
*



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়