ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অবশিষ্ট একটি জলদাস পরিবার!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবশিষ্ট একটি জলদাস পরিবার!

রফিকুল ইসলাম মন্টু : সেখানে অবশিষ্ট মাত্র একটি জলদাস পরিবার! নিতান্তই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী পরিবারগুলো শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানামূখী পরিবর্তন আর প্রতিবন্ধকতায় একে একে চলে গেছেন প্রায় সকলেই। জালের সঙ্গে বাঁধা জীবনতরী। যে জালে মাছ শিকার, সেই জালেই বন্দি জীবন। শিশুকাল থেকে বাবার কাছে মাছ ধরতে শেখা, বড় হয়ে দক্ষ জেলে হয়ে ওঠা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পেশায়তেই জীবিকা। বাপ-দাদার আদি পেশা আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা সবার। এই পেশা বাদ দিয়ে কেউ অন্য পেশায় জীবিকার পথ খোঁজেনি, শিক্ষা-দীক্ষায় জীবনের গতি বদলানোর চেষ্টাও করেনি। তবুও জীবন যুদ্ধে পরাজিত ওরা।

এ গল্প উপকূল জেলা নোয়াখালীর হাতিয়ার তমরুদ্দি ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের আদি বৃত্তিজীবী জলদাস সম্প্রদায়ের। এখানে এই সম্প্রদায়ের বেশকিছু লোকজনের দেখা পেয়েছিলাম ২০১৩ সালে। প্রায় শ’খানেক পরিবার ছিল। মাত্র ছ’বছরের ব্যবধানে সেখানে পাওয়া গেল মাত্র একটি জলদাস পরিবার। ২০১৩ সালে জেলেপল্লীতে কথা বলে জেনেছিলাম, মেঘনা নদীর ভাঙনের তীরে প্রতিনিয়ত দুর্যোগ-দুর্বিপাকে জেগে আছে জলদাস পল্লী। নারী-পুরুষ ও শিশুদের একই কাজ। নদী থেকে মাছ ধরা, মাছ ধরে আনার পর বাছাই করা, শেষে বাজারে বিক্রি করা। এতেই তাদের জীবিকা। ভোর থেকে অধিক রাত পর্যন্ত খাটুনি, আর রাতে রাস্তার পাশে ঝুপড়ির মত ঘরে মাথাগোঁজা। জলদাস সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষেরা জানান, সমুদ্র আর নদীর উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে আছেন তারা। চারপাশের বিকৃত পুঁজিবাদী সমাজের আক্রমণে রাহুগ্রস্ত তারা। শোষণ, দাদন, মধ্যসত্ত্ব প্রথাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা এই আদি জেলেদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে এই সম্প্রদায়ের নাগরিকেরা চরম সংকটের মুখে। একদিকে সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরতে প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই, অন্যদিকে পেশা ছেড়ে অন্য কাজে ফেরাও এদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কারণ মাছধরা ছাড়া কোন কাজই এরা জানেন না।

প্রথমবার ২০১৩ সালে এই জেলেগ্রামে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। ছ’বছর পরে গ্রামে গিয়ে ফলোআপে বসতেই ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পাই। ল্যাপটপ থেকে ছবিগুলো বের করি। একে একে দেখাই গ্রামবাসীকে। এগিয়ে এলেন সন্ধ্যা রাণী জলদাস। সংবাদ প্রকাশের কারণে তার ছবিটা বেশ পরিচিত সবার কাছে। একমাত্র এই পরিবারটিই এখানে আছেন। তারাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আরও কয়েকজনের দেখা মিলল, যারা এরই মধ্যে পরিজনসহ অন্যত্র চলে গেছেন। এখন মালামাল নেয়ার জন্য এসেছেন। সন্ধ্যা রাণীর স্বামী ক্ষিতিশচন্দ্র জলদাস। দুই ছেলে রবি দাস আর অর্জুন দাস নদীতে কাজ করে আর একমাত্র মেয়ে কনিকা রাণী চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। ঘরের সামনে সন্ধ্যা রাণীর সঙ্গে কথা বলার সময় হাজির হলেন  ক্ষিতিশচন্দ্র। জানালেন, মাছ না পাওয়া, নদীতে জাল ফেলায় নিষেধাজ্ঞা, দেনার দায়ে জর্জরিত হওয়া, মাছের দাম না পাওয়া, কাজকর্ম না থাকায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানো, মহাজনদের কবজায় বন্দি থাকার সংবাদ। এসব গল্প ওদের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছে যুগ যুগ ধরে। পূর্ব পুরুষের আমল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এলেও এখন আর এ পেশায় টিকে থাকা যাচ্ছে না। ক্ষিতিশ জানান, পেশায় টিকতে না পেরে অনেকেই এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ কেউ ভারতে স্বজনদের কাছে ফিরেছেন। ক্ষিতিশ নিজেও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানালেন।

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এলাকার জলদাস সম্প্রদায়ের অবস্থার ক্রমাবনতি হতে থাকে। ছ’বছর আগে কথা বলেছিলাম কোড়ালিয়া গ্রামের রতনচন্দ্র জলদাসের সঙ্গে। বয়স তার চল্লিশের কোঠায়। নিকট সমুদ্র আর নদীতে মাছ ধরে জীবন চলছিল। সেই ছোটবেলায়, যখন কাপড় পরার প্রয়োজন হয়নি, তখন থেকেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরেন। এই বয়সে এসে দক্ষ জেলে। হাল নেই, চাষ নেই, জমি নেই, মাছ ধরেই কোনমতে ধুঁকে ধুঁকে চলে জীবন। বেহুন্দি জাল নদীতে ফেলতে হয় চুরি করে, এই সম্প্রদায়ের উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এই জাল ফেলায় রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। রতন জলদাসকে এবার গিয়ে গ্রামে পাওয়া যায়নি। জীবনে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে সমুদ্র আর নদীতে মাছ ধরে পরাজিত পঁয়ষট্টি বছরের হিরন্ময়চন্দ্র জলদাস। ছ’বছর আগে তার সঙ্গে কোড়ালিয়া বাজারে দেখা। শারীরিক সমস্যার কারণে কাজ করতে পারছিলেন না। আর্থিক দৈন্য চরমে, চিকিৎসায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। ছেলে গীরেন্দ্র জলদাসের সংসারের বোঝা এখন। ছেলেরও সম্পদ নৌকা আর জাল। হিরন্ময় জীবনের শেষ প্রান্তে, এখন হাল ধরেছেন তার ছেলে। একসময় হয়তো তার ছেলেরও প্রস্থান ঘটবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না। হিরন্ময় জেলেগ্রাম ছেড়ে গেছেন অনেক আগেই।



জলদাস সম্প্রদায়ের এইসব মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তমরুদ্দি ইউনিয়নের পশ্চিম জোড়খালী গ্রামের বাজারে। সম্প্রদায়ের সংকটের তথ্য নিতে আর ছবি তুলতে গেলে ভিড় জমে যায়। ভরদুপুরে এঘর-ওঘর থেকে ছুটে আসছেন অনেকে। নারী-পুরুষেরা প্রত্যেকেই কথা বলতে চান। সবার কাছেই আছে কষ্টকর জীবনের এক একটি বিরাট গল্প। পশ্চিম জোড়খালী গ্রামের বিসম্বর জলদাসের বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। মাত্র সাত বছর বয়সে নদীতে। বাবার সঙ্গে মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে, আর অন্যের ট্রলারে সমুদ্রে মাছ ধরেছেন। সে হিসাবে সমুদ্র আর নদীর সঙ্গে বসবাস প্রায় ষাট বছর। বিসম্বর বলেন, আমাগো ব্যবসা হলো মাছ ধরা। যদি লেখাপড়ার কথা বলেন, তাহলে আমাদের পেট চলবে কী করে? তিনবেলা ভাত তো যোগাড় করতে হবে।               

ত্রিশ বছর বয়সেই বিধবা অঞ্জলি জলদাস। মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে আর ফিরে আসেনি স্বামী। ষোল বছর বয়সী ছেলে কিশোর প্রাণনাথ জলদাস জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তার কাজে সাহায্য করে অঞ্জলির অপর দুই সন্তান দশ বছরের প্রিয় জলদাস ও আট বছর বয়সী যমুনা জলদাস। এই বয়সেই ওরা জীবিকার চাকা ঘুরানোর কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে। মাছ ধরতে গিয়ে কমলা জলদাসের স্বামী কৃষ্ণকুমার জলদাস, কানুচন্দ্র জলদাসের স্বামী নেপালচন্দ্র জলদাসসহ অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই পরিবারগুলো চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছে। আর্থিক দৈন্যে শিক্ষা, চিকিৎসা সব দিক থেকেই পিছিয়ে আছে জেলেগ্রামের পরিবারগুলো। হাতিয়ার লঞ্চঘাট সংলগ্ন তমরুদ্দি বাজার থেকে হাটাপথ কোড়ালিয়া বাজার। বাজারে খালে ছিল বাঁশের সাঁকো। কিন্তু সেখানে এখন বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাজারের ঠিক পশ্চিম পাশে মেঘনার তীর লাগোয়া জলদাস সম্প্রদায়ের গ্রাম। শেষবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের ধারে ঘরগুলো সেভাবেই পড়ে আছে। জলদাস সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। এক কিশোরীর সঙ্গে দেখা, নাম আমেনা। আরেক কিশোরের সঙ্গে দেখা, নাম রহিম। না, জলদাস পরিবারের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে জানা গেল, জলদাস সম্প্রদায়ের সেই ঘরগুলোই কিনে রেখেছে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন। এই গ্রামের মানুষের এখন আর মাছ ধরার ব্যস্ততা নেই। গ্রামের ঘরগুলো পেরিয়ে নদীর ধারে যাই, নৌকাগুলো পড়ে আছে। মাছ ধরার লোক নেই। নেই মাছ আসার অপেক্ষা।   

গবেষণা সূত্র বলছে, জলদাস সম্প্রদায়ের অধিকাংশই সমুদ্র তীরবর্তী জেলে। নদী তীরবর্তী জেলেদের চেয়ে সমুদ্রতীরবর্তী জেলেরা বেশি সংকটে থাকে। কারণ নদী তীরবর্তী জেলেরা নদীতে মাছ না পেলে অন্য কাজ করতে পারেন, কিন্তু সমুদ্রতীরবর্তী জেলেদের অন্য কাজে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিংবা গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার সামর্থ্যও তাদের নেই। ফলে জলদাসদের চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হয়। এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ অন্যন্য বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ থাকে না এদের। জলদাস সম্প্রদায়ের সমস্যা ও সংকট সম্পর্কে এই সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস বলেন, জলদাসরাই আদি জেলে। একমাত্র মাছ ধরেই এদের জীবিকা চলে। নিত্যনৈমিত্তিক জলফসল তুলতে এরা জাল ফেলে সমুদ্র কিংবা নদীতে। এই সম্প্রদায়ের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ দারিদ্র্য। এই কারণে লেখাপড়াও এগাচ্ছে না। এদেরকে উৎসাহিত করতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর গুরুত্বটা বোঝাতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়