ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বেড়িবাঁধ সুরক্ষার তাগিদ দিয়ে গেল ‘ফণী’

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বেড়িবাঁধ সুরক্ষার তাগিদ দিয়ে গেল ‘ফণী’

রফিকুল ইসলাম মন্টু: প্রবল শক্তিধর ঘূর্ণিঝড় ফণী’র প্রভাবে লন্ডভন্ড হলো উপকূল। অনেক আগে থেকেই ছিল সতর্কতা, ছিল ব্যাপক প্রস্তুতি। শক্তিশালী আঘাত থেকে আমরা রক্ষা পেলেও ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। ১৬টি তাজা প্রাণ গেছে। অন্তত সহস্রাধিক ঘরবাড়ি তছনছ করেছে এই প্রলয়। বিধ্বস্ত-বিপন্ন বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। যেকোন ঘূর্ণিঝড় চলে যাওয়ার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে নানান পরামর্শ-সুপারিশ দেন।  তবুও সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে উঠে আসে বেড়িবাঁধ সুরক্ষার বিষয়টি। এবারও সে প্রশ্ন আসছে। বারবার একই প্রশ্ন এলে সেখানে আমরা কেন নজর দিতে পারছি না? উপকূল অঞ্চলের অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ বিপন্ন অবস্থায় রেখে আমরা কীভাবে জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবো?

ঘূর্ণিঝড় ফণী’র ঝাপটা বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগোতে শুরু হলে বিভিন্ন ধরনের খবর বেরোয় সংবাদ মাধ্যমে। আনেক আগেই বিধ্বস্ত হয়ে আছে, এমন বাঁধগুলো ফণী’র ধাক্কায় বিধ্বস্ত হয়েছে বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে অনেক স্থানে। দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে নাজুক কিংবা আগেই বিধ্বস্ত হয়ে থাকা বেড়িবাঁধকে ফণীর প্রভাবের সঙ্গে মিলিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাদের দায়মুক্ত করার পক্ষে নই। ফণি’র প্রভাবে বাঁধ ভেঙ্গেছে, এটা বলার মানে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মুক্তি পেয়ে গেলেন। সংবাদের সূত্র ধরে সহজেই নিজের গাফিলতি ফণী’র ঘাড়ে তিনি চাপিয়ে দিলেন। আবার বিশেষ কোটায় নতুন বরাদ্দও পাবেন। কিন্তু তার আগে আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত উপকূলের বাঁধগুলো দিনে দিনে কেন এতটা ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। পূর্ব উপকূল থেকে যদি আসি, কক্সবাজারের টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলার মনপুরা, তজুমদ্দিন, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, মির্জাগঞ্জ, রাঙ্গাবালী, বরগুনার বুড়িরচর, নাপিতখালী, বাগেরহাটের শরণখোলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, গাবুরা, দাতিনাখালী, খুলনার কয়রাসহ আরও অনেক এলাকায় ঝূঁকিপূর্ন বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো এলাকায় বেড়িবাঁধ দু’মাস আগে, ছ’মাস আগে, এক বছর আগে কিংবা দু’তিন বছর আগে থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রতিটি অমাবশ্যার জোয়ারে ভাঙা স্থানগুলো দিয়ে পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ফণী’র সতর্কবার্তা না এলেও এবারের অমাবশ্যার জোয়ারে এইসব এলাকা দিয়ে পানি ঢুকতো।  ফণী’র প্রভাবের কারণে বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। এবং অনেকে ফণী’র সঙ্গে যুক্ত করে বিষয়টির গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছেন। গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলাটা দোষের কিছু নয়। তবে আমার প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর এক একটি স্থানকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে কীভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা যাবে? মানুষজন ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক বার্তা পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটবে, নাকি বেড়িবাঁধ নিরাপদ রাখার চেষ্টা করবে। ফণী’র আঘাত থেকে বাঁচতে খুলনার কয়রার কপোতাক্ষ তীরের মানুষেরা সম্মিলিতভাবে একটি বাঁধ রক্ষা করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে বাগেরহাটের মোংলায়। প্রবল স্রোতে ওইসব বাঁধ ছুটে গেলে বহু মানুষের বিপদ হতো।

সুন্দরবন লাগোয়া উপজেলা খুলনার কয়রার অধিকাংশ স্থানে বেড়িবাঁধ নাজুক। বেড়িবাঁধের উচ্চতা কোথাও তিন ফুট, কোথাও চার ফুট, কোথাও পাঁচ ফুট। এই বাঁধ উপচে যেকোন সময় স্বাভাবিক জোয়ারের পানিও ঢুকতে পারে। ২০০৯ সালের আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর লবণ পানিতে ভেসে গিয়েছিল এই জনপদ। অনেক কষ্টে মানুষ সে ধকল কাটিয়ে উঠেছিল কয়েক বছরে। কিন্তু এখন আবার সে রকম কোনো ঘটনা ঘটলে (আমরা চাই না ঘটুক) মানুষের বিপদের শেষ থাকবে না। কয়রার নিকটবর্তী সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়র গাবুরার নামটি দেশে বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে। সেবার এই দ্বীপ পুরোটাই প্লাবিত হয়েছিল। এখনও ম্রিয়মান গাবুরা। যেন আইলার ক্ষতটা শুকোয়নি। খুবই নিচু বেড়িবাঁধ এখানে। ঝড়-ঝাপটা তো দূরের কথা, জোয়ারের পানি বাড়লেই এখানকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়ে। অমাবশ্যার জোয়ারের সময় এখানকার বাসিন্দারা নির্ঘুম রাত কাটায়, বিপন্ন বাঁধ পাহারায় থাকে। অনেকবার স্থানীয় উদ্যোগে এখানকার বাঁধ সংস্কার হয়েছে। কিন্তু গাবুরা এখনও নিরাপদ নয়। গাবুরার ঠিক পাশেই শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী, দূর্গাভাটি এবং পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালাকাঠি। খোলপেটুয়ার পাড়ের এই জনপদ ঝুঁকিতে থাকে বারোমাস। পাশের আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের শ্রীউলা আর আশাশুনি সদরের দিকে চোখ ফেরালেও দেখি একই চিত্র। বর্ষা মৌসুম এলে সংবাদকর্মীরা বাঁধ ভাঙার সংগ্রহে ছুটে যান। প্রকাশিত হয় খবর। কিন্তু কার খবর কে দেখে!

এবার একটু এগিয়ে আসি বাগেরহাটের শরণখোলায়। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কথা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। শরণখোলার সাউথখালী-গাবতলায় আঘাত করেছিল সিডর। এর পাশে বগী এলাকাটি, যেখানে বাঁধ বিধ্বস্ত। সিডরের পর এ এলাকার অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। সেই উন্নয়নের অংশ হিসাবে শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জের চারদিক ঘুরিয়ে উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ কাজ হচ্ছে। কাজ চলমান অবস্থায় বগীতে নতুন বাঁধে আকস্মিক ভাঙন দেখা দেয়। গত এক বছরে অন্তত পাঁচবার ভাঙনের শিকার হয়েছে ওই এলাকার বাঁধ। কেন নতুন বাঁধে ভাঙন দেখা দিল? এই প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, নদী শাসন না করে ভাঙন কবলিত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করায় বারবার বাঁধ ভাঙছে। বগীর ভাঙন কবলিত এলাকার পাশ দিয়ে যে রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেটাও ছিল নাজুক। প্রতি অমাবশ্যায় রিং বাঁধ উপচে কিংবা ভেঙে পানি প্রবেশ করে। ফণি’র প্রভাবেও সেটাই ঘটেছে। এ ঘটনা ফণী’র সঙ্গে মিলানো হোক বা না হোক, সেটা বড় কথা নয়। এই বিপন্ন বাঁধ সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়াটাই জরুরি।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নিজামপুর, লালুয়া এবং কুয়াকাটার মানুষ অমাবশ্যার জোয়ারে ভয়ে থাকেন। লালুয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর রিং বাঁধ দেওয়া হলেও অমাবশ্যার জোয়ারে আশপাশ দিয়ে পানি ঢুকে। নিজামপুরের বিধ্বস্ত বাঁধ এখনও সংস্কারবিহীন। জোয়ার এলে সেখান থেকে পানি ঢুকে হু হু করে। তলিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলি জমি। এখানকার অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তাদের কষ্টের কথা। গ্রামবাসীদের অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বাড়িতে থাকা যায় না, জমিতে ফসল হয় না। যারা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছেন তারা জানেন, কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে খানিক পশ্চিমে রয়েছে অত্যন্ত নাজুক বেড়িবাঁধ। বছরের পর বছর বিপন্ন অবস্থায় পড়ে আছে অনেকখানি বাঁধ। বালুর বস্তা ফেলে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর অনেক স্থানে রয়েছে নাজুক বেড়িবাঁধ। দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজ ও চালিতাবুনিয়ার অবস্থাও নাজুক। এইসব এলাকায় জলবায়ু অর্থায়নেও অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবন নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঢুকে না, পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মিত বেড়িবাঁধে ব্যক্তিগতভাবে স্লুইজ করার অনুমতি কে দেয়? চরমোন্তাজের চারদিকে বেড়িবাঁধে যতগুলো স্লুইজ আছে, তার বেশিরভাগই ব্যক্তিগতভাবে নির্মাণ করা। প্রভাবশালীরা মাছের চাষ করার সুবিধার্থে এগুলো করে নিয়েছে কারো অনুমতি ছাড়াই। এ কারণে অনেক স্থানে দেখেছি বেড়িবাঁধ নাজুক হয়ে পড়েছে।

ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরার চারিদিকে যে বেড়িবাঁধ রয়েছে, তার অধিকাংশই নাজুক। সকল সময়ে অমাবশ্যার জোয়ারে পানি ঢুকে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। ফণীর প্রভাবেও ঢুকেছে পানি। চরফ্যাসনের দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচরের মানুষ এবারের ফণী’র ঝাপটায় আতঙ্কে সময় পার করেছে। যে দ্বীপের ভাঙন শুকনো আর বর্ষা মৌসুম চেনে না, অবিরাম ভেঙে চলে, সে দ্বীপের সুরক্ষার কথা তো আমাদের অনেক আগেই ভাবতে হবে। ভোলায় আরও কয়েকটি দ্বীপ ইউনিয়ন রয়েছে বেড়িবাঁধ বিহীন। ঠিক ভোলা থেকে আমরা যদি পূর্বে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে যাই, দেখি আরেক বিপন্নতার চিত্র। বেড়িবাঁধ-রাস্তাঘাট তো বহুবার ভেঙেছেই, নির্মানাধীন বেড়িবাঁধও এক বছরে ছয় বার ধ্বসে গেছে। দুর্যোগ এলে কমলনগর এবং রামগতির একাংশের মানুষ থাকে আতঙ্কে। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার খবর যারা রাখেন, তারা ভালো করেই জানেন সেখানকার নলচিরা-সুখচরের ভাঙনের কথা। সুখচরের ‘সুখ’ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। আরেক দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের চারিদিকে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান থাকলেও রোয়ানুর ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজারের কুতুবদিয়া কিংবা মহেশখালীর অনেক স্থান এখনও বাঁধবিহীন। ফলে সেসব এলাকার মানুষ সব ধরনের দুর্যোগে আতঙ্কে থাকে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কথাও প্রায় সকলেরই জানা। বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে সে দ্বীপের উপর দিয়ে। বেশ কয়েক বছর বিপন্ন অবস্থায় থাকার পর কিছুদিন আগে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও তাতে ওঠে নানান অনিয়মের অভিযোগ। দ্বীপের চরের বালু দিয়েই নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। বাঁধের পাশের বালু তুলে বাঁধ নির্মিত হলে সে বাঁধ টিকবে কী করে?

উপকূলীয় বাঁধ নিয়ে অভিযোগ আর প্রশ্নের অন্ত নেই। ফণী’র আগে ইতোপূর্বে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় এসেছে, সবগুলোর ক্ষেত্রেই ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ ছিল ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ। প্রবল শক্তিধর ঘূর্ণিঝড় ফণীর ক্ষেত্রেও সেটাই লক্ষ্য করা গেছে। অন্য ঘূর্ণিঝড়গুলোর মতো ফণীও তাগিদ দিয়ে গেল উপকূলীয় বাঁধ সুরক্ষার। প্রশ্ন জাগে, এইসব জনপদ নিরাপদ রাখার দায়িত্ব কার? আমরা ঘূর্ণিঝড় এলে কেন তাড়া করি? প্রশ্ন তুলি? আগে কেন ব্যবস্থা নেই না? পাশের দেশ ভারতের উপকূলের কথা বাদই দিলাম, বাংলাদেশেও শক্ত নিরাপদ বাঁধ নির্মাণের দৃষ্টান্ত আছে। ভাসানচরে যতটা নিরাপদ বাঁধ নির্মাণের কথা শুনেছি, সেটা পর্যায়ক্রমে সমগ্র উপকূলেই করা যেতে পারে। আমাদের টাকা কম। বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগবে। কিন্তু উদ্যোগটা থাকতে হবে। তাহলেই একদিন স্বপ্নের চূড়োয় পৌঁছানো সম্ভব হবে। আরো নিরাপদ হবে উপকূল।

লেখক : উপকূল-অনুসন্ধানী সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়