ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ময়মনসিংহের ‘শশীলজ’

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ১৪ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ময়মনসিংহের ‘শশীলজ’

শামীম আলী চৌধুরী: ১৯৬৬ থেকে ১৯৮২...!! আমার মা’য়ের চাকরির সুবাদে দীর্ঘ ১৬ বছর আমার শৈশব ও কৈশর কেটেছে ময়মনসিংহের জমিদার বাড়ি শশীলজ-এ। ছবিটি যখনই দেখি তখন বুকের ভিতর একটা চাপা সুখের কান্না ভেসে ওঠে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনী শশীলজ-এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

ময়মনসিংহ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর বাড়ি শশীলজ। ১৯০৫ সালে ৯ একর জমির উপর এই জমিদার বাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন তিনি। মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম একটি পুত্রসন্তান ভীষণভাবে প্রয়োজন। তাই দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন রঘুনন্দন। মৃত্যুর আগে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করেন।



জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি। সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটে তাঁর। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তাঁর বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্দ্রকান্তকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। পুনরায় দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী।

সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশীলজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশীলজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্য বর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কারকাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রয়াসে শশীলজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর, অপরূপ।



এই হলো মোটামোটি শশীলজের ইতিহাস। জমিদারী প্রথা শেষ হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার জামিদারদের সকল ভবন ও সম্পত্তি সরকারের খাস জমি ও ভবন হিসেবে ঘোষণা দেয়।  সরকার এই ভবনটিকে ‘মহিলা শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়’ স্থাপন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ করে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার হেরিটেজ ভবন হিসেবে মূল ভবনটিকে ‘মহিলা শিক্ষিকা প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়’ থেকে আলাদা করে প্রত্মতাত্বিক ও যাদুঘরের অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেন। বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ জাদুঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

লেখক: চাকরিজীবী এবং সৌখিন ফটোগ্রাফার
ছবি: লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৯/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়