ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নিপুণ ছদ্মবেশে ভয়ঙ্কর ছলনা

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৯, ২৬ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নিপুণ ছদ্মবেশে ভয়ঙ্কর ছলনা

খুন করে চোখ উপড়ে নিচ্ছে ঠগির দল। ছবি: উইকিপিডিয়া

হুমায়ূন শফিক: ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ। আপনি ব্যবসার কাজে উত্তর ভারতের কোনো জায়গায় গিয়েছেন। সেখান থেকে কাজ শেষ করে রওনা হয়েছেন অন্যত্র। একা একা ঘোড়ার গাড়ি বা হেঁটে যাচ্ছেন। সঙ্গে টাকা-কড়ি বেশ ভালোই আছে। আপনার ভয় লাগছে- ডাকাত ধরবে নাতো! কিছুদূর এগিয়ে আসার পর কয়েকজনকে দেখলেন। তারাও হয়তো আপনার মতই ব্যবসার কাজে বেরিয়েছে। দেখে আপনার ভয় কেটে গেল! তাদের সঙ্গী হলেন। তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলেন লোকগুলো খুবই ভালো। সন্ধ্যা নামতেই ছোট তাবু ফেলে, পাশেই রান্নার আয়োজন শুরু হলো। কয়েকজন গান-বাজনাও শুরু করে দিল। কিন্তু হুট করেই বুঝলেন কেউ একজন আপনার গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়েছে। আপনি নিজেকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই পেলেন না। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করার আগেই কয়েকজন চেপে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার মৃত্যু হলো। আপনি জানতেই পারলেন না কারা আপনার সঙ্গী হয়ে এসেছিল এতোটা পথ!

শ্রীপান্থ ‘ঠগি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘ওরা হৃদয়হীন মানুষ, ইতিহাসের হিংস্রতম, নিপুণতম খুনী- ওরা ঠগি।’ তিনি তাদের খুনের উপকরণ নিয়ে লিখছেন: ‘উপকরণ অতি সামান্য। ঢাল নয়, তলোয়ার নয়, বোমা-পিস্তল-কামান-বন্দুক- কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়, একমাত্র হাতিয়ার সেই হলুদ রঙের রুমাল। রুমাল নয়, ওরা বলত ‘পেলহু’। কিংবা সিকা। খুলে রাখলে মনে হবে যেন পাগড়ী খুলে রাখা হয়েছে, অথবা ‘সাস’- কোমরবন্ধনী হিসিবে ব্যবহৃত কোনো কাপড়। দু’ভাঁজে ভাঁজ করার পর সেটির দৈর্ঘ্য মাত্র তিরিশ ইঞ্চি। আঠারো ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট। গিঁটের প্রান্তে একটি রুপোর টাকা বাঁধা। নয়তো তামার একটি ডবল পয়সা। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে মেপে মেপে অতি যত্নসহকারে ওরা যখন সেটি তৈরি করে, তখন দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। রুমালটা আসলে একটা ফাঁস। প্রান্তে বাঁধা সিঁদুর মাখানো টাকা ফাঁস আরও নির্ভুল, আরও নিটোল করার জন্য।’

ভিন্ন বানান ও উচ্চারণে বাংলাসহ দক্ষিণ এশীয় সব ভাষায় প্রচলিত একটি শব্দ ঠগি। এর শাব্দিক অর্থ ধোঁকাবাজ, প্রতারক। ইউরোপীয়গণ ঠগি শব্দটির গৃহীত মর্যাদা দেয়ার আগেও উত্তর ভারতের মানুষ তাদের ‘ফাঁসিগর’ বলত। শব্দটির উৎপত্তি ‘ফাঁসি’ থেকে। ঠগিদের উৎপত্তি অস্পষ্ট। সতেরো এবং আঠারো শতকে, বিশেষ করে কোম্পানির শাসনের প্রতিষ্ঠালগ্নে এদের উদ্ভব ঘটে। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের দুস্কৃতিপরায়ণ উপজাতি হতে উদ্ভূত হয়ে ঠগিরা নওয়াবী আমলের শেষ ও ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্নে ক্রমান্বয়ে প্রায় পুরো ভারতে তাদের কর্মপরিধি বিস্তার করে। তারা ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলাসহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা ছিল কালীর পূজারী। তাদের কথা প্রথম জানা যায় ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে। ১৮৩০ সালে গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতে প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে ঠগিদের নির্মুল করতে নির্দেশ দেন। হেনরি শ্লীম্যান কয়েক বছরের চেষ্টার ফলে ঠগিদের নির্মুল করতে সমর্থ হন। ঠগিরা ছিল ভারতীয় খুনি কাল্ট। তারা যত মানুষ হত্যা করেছিল পৃথিবীর কোনো সংগঠিত খুনিরা এত নিরীহ মানুষ হত্যা করেনি। কেবল ১৮৩০ সালেই ঠগিরা প্রায় ৩০ হাজার মানুষ শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে মৃতদেহ দেবী কালীমাতাকে উৎসর্গ করেছে। হয়তো কোনো প্রকারে হত্যাপ্রবণ ঐ আদিম রীতিটি ভারতীয় সমাজে তখনও টিকে গিয়েছিল। ঠগিদের ইংরেজরা বলত Thuggee, এখান থেকেই ইংরেজি শব্দ Thug এর উৎপত্তি।

ভূপ্রকৃতি এবং পরিবহণ ব্যবস্থাভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে ঠগিদের কার্যপ্রণালী বিভিন্ন ধরনের ছিল। সাধারণত তারা দূরের যাত্রী ও তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে দল বেঁধে চলাচল করত। আগন্তুক ভ্রমণকারীদের সঙ্গে মিশে যেত এবং তাদের প্রতি সহৃদয়তা ও সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করে বিশ্বাস অর্জন করত। সময়-সুযোগ বুঝে ও নির্ধারিত স্থানে ঠগিরা প্রথানুযায়ী হতভাগ্য শিকারের গলায় রুমাল পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত, সর্বস্ব লুট করত এবং ঠগি প্রথানুসারে তাকে সমাহিত করত। উদাহরণস্বরূপ, পরবর্তী শিকারের উদ্দেশে অগ্রসর হওয়ার আগে তারা সদ্যকৃত ঘটনাস্থলে সারারাত পান-ভোজন ও নাচগান করত। বাংলার ঠগিরা প্রধানত নৌপথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। নদীর ঠগিরা সাধারণত হতভাগ্যদের মাথা পানিতে চুবিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করত। ঠগিরা শীত মৌসুমে বাংলার জেলাসমূহে আসত এবং বংশগত স্থানীয় অপরাধীদের সহযোগিতায় বর্ষাকাল আসার আগ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেত। উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের প্রশাসন ঠগিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক ও বেসামরিক অভিযান পরিচালনা করে।

দুই.

ঠগিরা নানান সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে বাক্য আদান-প্রদান করতো। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক অনুচরকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিতো। ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়ামাত্র মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়। গোষ্ঠীভুক্ত না হলে তাদের সংকেতের পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব। তারা বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিলো। সবার আগে থাকতো ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সাথে ভাব জমানো এবং শিকার সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর। পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদের বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকতো। নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকতো ‘নিসার’দের ওপর। কবর তৈরি করার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতো ‘বিয়াল’। শিকার যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’।  শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে সেজন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। চুমিয়া শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে আর ‘ভোজারা’ মৃতদেহ কবরে নিয়ে যাবে। ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেয়া। মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’ আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিলো ‘ফুরজানা’দের। সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসতো ঠগিদের অমৃতের ভোজ। ভোজ তেমন আহামরি কিছু নয়, গুড়ের ভোজ। তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগি হয়ে যাবে। ঠগিদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিলো।

তিন.

একবার দেবী কালী অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু অসুরদের প্রতি ফোঁটা রক্ত থেকে জন্ম নিচ্ছিল আরও সহস্র অসুর। তাই দেবী তার ঘাম থেকে জন্ম দিলেন ঠগিদের। সেই থেকে ঠগিরা হত্যা করতে শুরু করল। ঠগিদের হত্যা করাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। মনে করা হয়- এটা ছিলো তাদের ধর্মীয় আচার। তাই তারা খুনগুলো করত ফ্যানাটিক দক্ষতার সাথে। আর লুটের সম্পত্তি ছিলো তাদের নিকট দেবীর উপহার। যেহেতু লুটপাট প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো না, তাই ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সম্পদশালী জমিদার কেউই রক্ষা পেত না। ১৩৫৬ সালের জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে থেকে জানা যায়, ১২৯০-এর দিকে সুলতানের আমলে কিছু ঠগ ধরা পরে। কেউ কেউ বলেন এর সংখ্যা এক হাজার। তাদের নতুন দিল্লী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সুলতান তাদের একজনকেও হত্যা করেননি। বরং তাদের নৌকায় তুলে ভাটির দেশে পাঠিয়ে দিতে নির্দেশ দেন যাতে তারা আর কোনোদিন দিল্লীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। [স্যার এইস.এম এলিয়ট, ভারতের ইতিহাস, iii. ১৪১]

 

তিনজন দস্যুর নির্যাতন। লখনৌ কারাগারে ঠগি দুস্যদের বর্ণনা  অনুযায়ী জলরঙে আঁকা ছবিটি ১৮৩৭ সালের। ছবি: উইকিপিডিয়া

ঠগিরা সাধারণত বংশপরম্পরায় হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন ঠগি বালক ১৮ বছর হলে হত্যার অনুমতি পেত। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার ঠগিদের কথা প্রথম জানতে পারে। সেসময় একটি গণকবরে ৫০টি মৃতদেহ গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ঠগিরা তাদের দেবীকে বাংলায় ‘ভবানী’ নামে ডাকত। তারা সাধারণত বছরের এক সময় ঘর সংসার করত এবং শরৎকালে দলগতভাবে যাত্রা করত মানুষ হত্যার জন্য। ঠগিরা দলের সর্দারকে ‘জমাদার’ নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার কালীঘাট ও বিন্ধ্যাচলের ভবানী মন্দির।

ঠগিদের নৃশংস ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে ফেরে ঠগিদের লোমহর্ষক কাহিনি। ঠগিদের নির্মম কাহিনি অবহিত হওয়ার পর ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ইম এম ফস্টার ১৯২৪ সালে অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন: ‘গড ইজ লাভ। ইজ দিস দ্য ফাইনাল মেসেজ অব ইন্ডিয়া?’ ঈশ্বর প্রেমই কি ভারতের চূড়ান্ত বক্তব্য? ফস্টার ভুল করেছিলেন। কেননা, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কালীসাধক মাত্রই খুনী, ভারতবর্ষের কালীসাধকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল কালীসাধনার অপব্যাখ্যা করে খুনী হয়ে উঠেছিল। 

ঠগিরা বংশপরম্পরায় খুন ও দস্যুবৃত্তি করত। ছোটবেলা থেকেই ঠগি পিতা ছেলেকে শেখাত কীভাবে শ্বাসরোধ করে ফাঁস দিয়ে হত্যা করতে হয়। ঠগি বালকের শিক্ষা শুরু হতো দশ বছর বয়সে। তখন সে লুকিয়ে হত্যাকাণ্ড দেখত। সাধারণত শক্ত কাপড়ের তৈরি হলুদ রঙের রুমাল ফাঁস করে গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করা হতো। রুমাল থাকত ঠগিদের কোমড়ে। কেন ফাঁস দিয়ে হত্যা? কেননা, কালীর আদেশে রক্তপাত নিষিদ্ধ। ঠগিদের আদিপিতা নাকি কালীর কাছে শিখেছিল ফাঁস দিয়ে হত্যার রক্তপাতহীন পদ্ধতি। এটি ডাহা মিথ্যে কথা। যিনি মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করেন তিনি কখনও দেবী হতে পারেন না। আগেই বলেছি, ভারতবর্ষের কালীসাধকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল কালীসাধনার ভ্রান্ত্র ব্যাখ্যার বশবর্তী হয়ে খুনি হয়ে উঠেছিল।

চার.

প্রথমদিকে কোনো তীর্থযাত্রী নিখোঁজ হলে ব্রিটিশ শাষকরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করত। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও নিখোঁজ হওয়া শুরু করল তখন গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক জানতে পারেন, এই কাজে একটি ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হাত রয়েছে। তখন তিনি ঠগি নির্মূল করতে ১৮৩০ সালে ভারতের প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানকে নির্দেশ দেন। শ্লীম্যান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ অফিসার। চারটি ভারতীয় ভাষা জানতেন তিনি। তিনিই সর্বপ্রথম ঠগিদের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেন। তিনি জানতেন ঠগিদের দমন করা সহজ না। কেননা, অন্যান্য দুস্কৃতিকারী থেকে ঠগিদের আলাদা করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া তারা সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল। ঠগি মানেই তো ঠগ; তারা নিপুণ ছলনাকারী। ফলে তিনি গুপ্তচর নিয়োগ করেন। গঠন করেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পুলিশ ফোর্স, বিশেষ ট্রাইবুন্যাল ও দ্রুত বিচার আদালত। এরই পাশাপাশি তিনি ঠগিদের অপরাধস্থল সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে মানচিত্র তৈরি করেন এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকাও তৈরি করেন; যার ফলে তিনি পরবর্তী গণহত্যার সময়কাল আঁচ করতে সক্ষম হন। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান। এভাবে ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে ৩,৭০০ ঠগি ধরা পড়ে। এদের জিজ্ঞাসাবাদের ফলে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন মাত্র ২০ জনের দল ৫,২০০ পথযাত্রীকে হত্যা করেছে। ঠগি সর্দার বেহরাম ছিল সিরিয়াল কিলার; সে ১৭৯০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে  ৯৩১টি খুন করে! তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- সেজন্য তার অনুশোচনা হয় কিনা? উত্তরে বেহরাম নির্বিকার কণ্ঠে বলেছিল, ‘ব্যবসার জন্য কারা আক্ষেপ করে!’ ৫০ জন ঠগিকে গোপন তথ্যাদি দেয়ায় ক্ষমা করা হয়। বাকিদের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ৫০০ ঠগিকে ঝোলানো হয় ফাঁসিতে। ফাঁসিকাষ্ঠে ঠগিরা ছিল অভিব্যক্তিশূন্য; বরং তারা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর আবেদন করে। যেভাবে তারা নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করত! ঠগিদের যে নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বর্তমানে ভারতীয় লেখকগণ তার বিরোধিতা করছেন। তাদের বক্তব্য, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই ঠগিদের অমন হিংস্র করে দেখানো হয়েছে। যা মূলত ভারতকে না বোঝার জন্যই হয়েছে। ভারতীয় সমাজে গুপ্ত সংগঠনের অস্তিত্ব যেমন হাস্যকর তেমনি ধর্মীয় কারণে ধারাবাহিক লুন্ঠনও অস্বাভাবিক। ঠগিরা আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং অন্যদের মতোই কালী উপাসক। বাধ্য হয়ে তারা হত্যা ও লুন্ঠনের আশ্রয় নিত বটে, তবে মৃতদেহ কালীকে উৎসর্গ করার বিষয়টি অবাস্তব। হলিউডি মুভি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দি টেমপল অভ ডুমস’-এ কুড়ি শতকের কালী উপাসক ঠগিদের দেখানো হয়েছে। ছবিটি যে কারণে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। ঠগিদের হাতে নির্মিত একটি কার্পেট এখনো ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদে আছে।

তথ্যসূত্র:

১. শ্রীপান্থ-ঠগি

২. ঠগি-উইকিপিডিয়া

৩. topyaps.com/thuggees-of-india


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৯/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়