ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত কোকিল

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩২, ২৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত কোকিল

শামীম আলী চৌধুরী: কোকিলের নাম শোনেননি বা চিনেন না এমন লোক দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোকিলের সুমিষ্ট সুর মন ভরিয়ে দেয়। বসন্ত কালে কোকিল আমাদের দেশে বেশি নজরে পড়ে। তাই আমরা বহুদিনের অদেখা কাউকে দেখলেই উপমা দেই ‘তুমি দেখছি বসন্তের কোকিল হয়ে যাচ্ছো’। কোকিলকে নিয়ে অনেক কবি বা ছড়াকার লিখেছেন। কোকিল আমাদের আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের সর্বত্র কোকিল চোখে পড়ে। গ্রামে ও শহরেও এদের বিচরণ যত্রতত্র। এরা বৃক্ষচারী পাখি। গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়ায়। এরা ফলভুক। বটের ফল প্রিয় খাদ্য। এদের দৈর্ঘ্য ৪২-৪৫ সে.মি. হয়।

পৃথিবীতে সব প্রাণীই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে। একমাত্র কোকিল ব্যাতিক্রম। এদের জীবন বৈচিত্র ও প্রজনন পরবর্তী কার্যকলাপ অন্যান্য পাখির মত নয়। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির পাখি। এরা কখনও তাদের ছানাদের চোখে দেখেনি। যার জন্য তারা মাতৃত্বের অধিকার নিয়ে ছানাদের লালন-পালন করতে জানে না। খুবই বৈচিত্রময় জীবন এই কোকিলের। এদের প্রজননের সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। এরা নিজেরা বাসা তৈরি করতে পারে না বা জানে না। অন্যান্য পাখিদের বানানো বাসায় মেয়ে কোকিল ডিম দেয়। দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। প্রজননের পর মেয়ে ও পুরুষ কোকিল এক সঙ্গে থাকে। এরা ধোঁকাবাজিতে পারদর্শী। যে কোন পাখিকে সহজেই ধোঁকা দেয়ার কৌশল এদের খুব ভালো করে জানা। খুব সহজেই অন্য প্রজাতির পাখিকে বোকা বানাতে পারে বলেই পরের উপর নিজেদের বংশ বৃদ্ধির দায়িত্ব অনায়াসে দিতে পারে।

বংশ বৃদ্ধির জন্য কোকিলের নিজস্ব কোনো গুণাবলীও নেই।  ডিম পাড়ার সময় হলে তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। কাক বা অন্যান্য পাখির বানানো বাসার আশেপাশে পুরুষ কোকিল ডাকতে থাকে। পুরুষ কোকিলের শব্দ পেয়েই কাক বা অন্যান্য পাখি যাদের বাসা তৈরি করা আছে ও সেই বাসায় ডিম আছে তারা পুরুষ কোকিলকে তাড়া করে। অন্যান্য পাখি মনে করে পুরুষ কোকিল তাদের ডিম ছিনিয়ে নিতে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। যখন কাক বা অন্যান্য পাখি পুরুষ কোকিলকে তাড়া করে সেই সুযোগে পাশে লুকিয়ে থাকা মেয়ে কোকিলটি অন্যান্য পাখির বাসায় টুপ করে বসে পড়ে ও সেখান থেকে দু’একটি ডিম সরিয়ে ফেলে। এবং সেখানে ডিমের সংখ্যা ঠিক রাখতে পাখিটি নিজের ডিম রেখে যায়।

 

 

এভাবে দুই থেকে তিনটি বাসায় মেয়ে কোকিল ডিম দিয়ে চিরতরে সেই স্থান ত্যাগ করে। কোনদিন ফিরেও দেখে না তার দেয়া ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো কিনা! অথচ অন্যান্য প্রজাতির পাখি ডিম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাতৃত্ববোধ জেগে উঠে। বংশধরদের জন্য তারা খুব সচেতন থাকে। পালা করে মেয়ে ও পুরুষ পাখি ডিমে তা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করে তোলে। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। অথচ কোকিল পরের বাসায় ডিম দিয়ে নিশ্চিন্তে উড়াউড়ি করতে থাকে। তারা জানেও না তাদের বাচ্চা কোনটি।

কাক বা অন্য পাখির বাসায় কোকিলের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চা ফোটার পর কোকিলের বাচ্চারা অদ্ভুত আচরণ করে। কাকের বাসায় রাখা কোকিলের ডিম থেকে সবার আগে বাচ্চা ফোটে। পরে সেই কোকিলের বাচ্চা অন্য ডিমগুলো ঠেলে বাসার নিচে ফেলে দেয়। মা পাখি দেখে দুটি ডিম নেই। তারপরও সে সদ্য ফোঁটা কোকিলের ছানাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ও পরম যত্নে লালন পালন করে। অনেক সময় এর ব্যতিক্রমও ঘটে। কাক বা অন্য পাখির বাচ্চার সাথে কোকিল ছানাও বড় হতে থাকে। বিভিন্ন খাবার মা ও বাবা পাখি সংগ্রহ করে কোকিলের ছানাকে খাওয়ায়। একসময় কাক বা অন্যান্য পাখি বুঝতে পারে এই ছানা তাদের না। তখন আপন মনে কোকিলের ছানা কাক বা অন্য পাখির বাসা থেকে উড়ে পালিযে যায়। এই হচ্ছে কোকিলের জীবন বৃত্তান্ত। মাতৃত্বের স্বাদ না নিয়েও তারা প্রকৃতিতে তাদের বংশ বিস্তার করে  যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।

কোকিল ফল ছাড়াও বিভিন্ন পোক খাবার হিসেবে বেছে নেয়। পুরুষ কোকিল কালো বর্ণের হয়। আর মেয়ে কোকিল দুধের স্বরের মত হালকা হলুদ বর্ণের দেহে পালকের উপর কালো কালো ফোটা থাকে। এদের চোখ রক্ত চক্ষুর মত লাল। পুরুষ ও মেয়ে কোকিলের চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বড় বড় গাছের ডালে এরা একা চলাফেরা করতে পছন্দ করে। এরা বিপদমুক্ত বাংলাদেশের সহজলভ্য পাখি।

বাংলা নাম: কোকিল

ইংরেজি নাম: Asian Koel

বৈজ্ঞানিক নাম: Eydynamys scolopacea

লেখক ছবিগুলো ঢাকা রমনা পার্ক থেকে তুলেছেন


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৯/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়