ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাঙছে ঘর, বদলাচ্ছে ঠিকানা

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ৪ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাঙছে ঘর, বদলাচ্ছে ঠিকানা

জুনাইদ আল হাবিব: কমলনগরে মেঘনা নদীপাড়ের খুব কাছে ঘরহীন ভিটেমাটি। তাতে শুয়ে আছেন এক ব্যক্তি। মানুষের কোলাহল না থাকলেও জোয়ারের ঢেউ তীব্র বেগে আঘাত করছে নদীপাড়ে। ঢেউয়ের প্রতিটি আঘাতে যেন এক একজন মানুষের এক একটা স্বপ্ন ভাঙছে।

মেঘনার ভাঙনের কারণে প্রতিদিন কেউ না কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে ঠিকানা বদল করছেন। কেউ রাস্তার ধারে, কেউ অন্যের বাড়িতে, কেউবা খোলা আকাশের নীচে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। নদী ভাঙনের শিকার প্রতিটি মানুষের চোখেমুখে স্বপ্নভঙ্গের বেদনার দাগ স্পষ্ট। বলছি, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর ফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া গ্রামের কথা।

লুধুয়া গ্রাম থেকে কয়েকটি পাহাড়ট্রলি চলাচল করতে দেখা যায়। এসব পাহাড়ট্রলি ভাঙা ঘরের টিন, কাঁঠের টুকরো প্রভৃতিতে ভরা। স্থানীয় মানুষের কাছে এ দৃশ্য একেবারে স্বাভাবিক।  তারা প্রতিদিনই অনেককে ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে দেখছেন।  নদী ভাঙন ধেয়ে আসছে কলেজ পড়ুয়া সোহাগের নানু বাড়ির দিকে। বাড়িতে কোনো ঘর নেই। ঘরের শূন্য সিঁড়ি পড়ে আছে। সোহাগ বলেন, ‘এটি যে আমার নানু বাড়ি তা চিনতেই পারছি না।’

 

সোহাগের নানু বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে নদীরপাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বৈদ্যুতিক পিলার। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। পল্লীবিদ্যুতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরা উদাসীন বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। বেশ কিছু ফাঁকা বাড়িতে দেখা যায়— মাটির তৈরি মটকা পড়ে আছে। এসব মটকায় চাল রাখা হতো। বাড়িগুলো এখন মানুষ শূন্য, এ মটকাগুলোও হয়তো নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।

পথ ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখা মিলে— নদীর একদম কূলেই টিনসেডের কয়েকটি চালা পড়ে আছে। সেখান থেকে বেশ দূরে নদীর বুকে শুয়ে আছে বিশাল আকৃতির একটি কড়ই গাছ। পাশেই দেখা যায়, ইটের তৈরি একটি বাড়ির বিভিন্ন ভাঙা অংশ পড়ে আছে। বাড়িটি হাজিরহাট উপকূল ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক প্রফেসর জামাল উদ্দিনের। নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বাড়িটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কড়ই গাছটির কাছে গেলেই সামনে জোয়ার রক্ষার বেড়িবাঁধ। বাঁধের চারপাশে কয়েকটি পরিবারকে মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখা যায়। কোনো মতে বেঁচে আছেন এসব মানুষ। যাদের ঝড়-ঝঞ্ঝায় নেই কোনো নিরাপত্তা। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তাদের ভরসা।

নদীপাড়ের বাসিন্দা আবদুস সাত্তার। বেড়িবাঁধের পথ ধরে তার বাড়িতে ঢুকতেই গাছ পাকা কাঁঠালের সুঘ্রাণ নাকে আসে। তারপর আবদুস সাত্তার সামনে নিয়ে আসেন কাঁঠাল, কলা, আম, ডাবের পানিসহ কয়েকটি পদের খাবার। এসব ফল তার বাড়ির গাছের। বাড়ির নারিকেল বিক্রি করে সংসারের অনেকটা ধারদেনা শোধ করেন তিনি। কিছু দিনের মধ্যেই আমড়া বড় হবে, আরো কত ফল ধরবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য নদীভাঙন দিন দিন এগুচ্ছে তার বাড়ির দিকে। সর্বনাশী নদী এসবই গ্রাস করবে। কী নির্মম তাই না! আবদুস সাত্তারের কাছে প্রশ্ন ছিল, অন্য কোথাও জমি কিনেছেন কিনা? জবাবে তিনি বলেন, ‘এখনো ঠিক করতে পারি নাই।’

 

চর ফলকনের লুধুয়া গ্রামের নদী ভাঙনের এ ধরনের গল্প বলে শেষ করা যাবে না। কারণ, এখানকার প্রতিটা মানুষ যেন এক একটা জীবন্ত গল্প। এবার লুধুয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণের উপজেলা পাটোওয়ারীরহাট এলাকার গল্প বলা যাক।

নদীভাঙনের তথ্য সংগ্রহের জন্য যাব, এমন খবরে এলাকার টগবগে তরুণ রাকিব হোসেন লোটাস হাজির হয়েছিলেন লোকজন নিয়ে। ভাঙনের ভয়ানক কিছু দৃশ্য পেতে একটি নৌকা নিয়েছিলাম। পাড় থেকে নদী খুব শান্ত মনে হলেও বাস্তবে খুব উত্তাল। ঢেউয়ের তোড়ে সামনে নৌকা চালিয়ে নিতে মাঝিকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। যেতে যেতে দেখা যায়, ঢেউয়ের সঙ্গে মাটির বড় বড় চাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই বহু মানুষের স্বপ্ন গিলে খাচ্ছে মেঘনা নদী।

নদীভাঙনের তথ্য সংগ্রহের জন্য সর্বশেষ গন্তব্য ছিল উপজেলার পশ্চিম চর লরেন্সের নবীগঞ্জ এলাকা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙনের আরেক ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ। নদীকূলে ভেঙে পড়ে আছে ফসলি জমির বড় বড় চাকা। আর তা স্রোতের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে মানুষের লালিত স্বপ্ন।

পড়ুন :

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়