ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলীয় এলাকার পাখি খোয়াজ

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৩ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলীয় এলাকার পাখি খোয়াজ

শামীম আলী চৌধুরী: কর্ম জীবনে চাকরির সুবাদে রাজশাহীতে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু পাখির ছবি তোলার জন্য প্রথম রাজশাহী যাই ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। পরিপাটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি শহর। বাস বা রেল স্টেশন থেকে নেমে শহরে প্রবেশ করলে মনে হবে প্রকৃতিতে ঘেরা ও ‍ছিমছাম নান্দনিক একটি শহর। কোথাও ময়লার স্তুপ নেই। সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে যানজট মুক্ত একটি শহর। সেই সঙ্গে শহরটিকে আরো আকর্ষণীয়  ও নান্দনিক করে তুলেছে পদ্মা নদীর তীর ঘেরা ‘টি-বাঁধ’।

ট্রেন থেকে নেমেই চলে যাই বাঁধ সংলগ্ন নদীর ঘাটে। আগে থেকেই নৌকা ঠিক করা ছিলো। ঘাটের পাড়ে শীতের সকালে এক কাপ রং চায়ে চুমুক দিয়ে রাতের অনিদ্রার ভাব কাটিয়ে যথাসময়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি পদ্মার বুকের উপর দিয়ে চলতে শুরু করে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা নদী। নদীর উপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে হরেক প্রজাতির পাখি। শীত মৌসুম থাকায় পদ্মায় চর জেগেছে। চরে বক, কালিকাক, পানকৌড়িসহ অনেক পাখি চোখে পড়ল। সবাই ব্যস্ত  খাদ্যের খোঁজে। এরই মধ্যে খুঁজে পেলাম সাদা বর্ণের ডানায় কালো রেখা একটি খোয়াজ পাখি। জীবনের প্রথম দেখাতেই পাখিটিকে ভালো লাগলো। মোট কথা পাখিটির প্রেমে পড়ে গেলাম।

 

খোয়াজ পাখি ৪৫-৪৬ সে.মি. দৈর্ঘের Recurvirostra পরিবারের মাঝারি আকারের সৈকত-পাখি। এই পাখির বৈশিষ্ট হচ্ছে ঠোঁট। কালো বর্ণের ঠোঁটের অগ্রভাগ উল্টানো। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েপাখি পুরুষের চেয়ে খাটো ও ঠোঁট উপরের দিকে বেশ বাঁকানো। পুরো দেহ সাদা। কপাল, মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পিছনের উপরের অংশ শুধু কালো বর্ণের। ডানার অগ্রভাগ ও মধ্য-পালকে দুটি কালো রেখা দেখা যায়। তাছাড়া দেহের বাকি অংশ তুষার সাদা। ওড়ার সময় পিঠের নিচে ২টি ও ডানার পালক ঢাকনি বরাবর ১টি কালো রেখা দেখা যায়। দুই ডানার অগ্রভাগেও কালো দাগ আছে। পাখিটি বসা অবস্থায় পিঠে ও ডানায় ৩টি কালো ফিতা চোখে পড়ে। এদের চোখ বাদামী বা লালচে। পা লম্বা ও পায়ের পাতা নীলচে ধুসর। পুরুষ ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

খোয়াজ উপকূলীয় এলাকার পাখি। সৈকতে দল বেঁধে ঝাঁকে-ঝাঁকে দেখা যায়। একটি ঝাঁকে ১৫০-২০০টি পাখি থাকে। মাঝে মধ্যে দলছুট হয়ে নদীর চরেও দেখা যায়। তবে সংখ্যা ১৫ থেকে ২০টি। কাঁদাযুক্ত চর এদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। আর সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করে। এদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো উল্টানো ঠোঁট কাঁদা চরে বা মাটিতে ড্রিল মেশিনের মতো প্রবেশ করে খাদ্য সংগ্রহ করা। অগভীর পানিতে হেঁটে বা সাঁতরে ঠোঁট দিয়ে এপাশ ওপাশ করে পানি বা কাদাতে এরা খাবার খোঁজে। এদের খাবার তালিকায় রয়েছে খুদে শামুক, চিংড়ি জাতীয় মাছ, পোকা ও শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলে জোয়ারের সময় এরা কাদামাটি, অল্প পানি বা একটু উঁচু জায়াগায় দাঁড়িয়ে থাকে। ভাটার সময় খাদ্য সংগ্রহের জন্য পুরো কাদা মাটিতে দৌড়ে বেড়ায়। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে এরা তীব্র কণ্ঠে ডাকে। অন্য কোনো পাখি বা শত্রু দ্বারা বিরক্ত হলে অবিরাম তীক্ষ্ম গলায় চেঁচিয়ে ডাকে।

 

খোয়াজ পাখি আমাদের দেশে শীতকালে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে পরিযায়ী হয়ে আসে। এরা আমাদের দেশে প্রজনন করে না। প্রজননের সময় নিজ নিজ আবাসস্থলে চলে যায়। এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসে প্রজনন করে। প্রজননকালে ইউরোপ ও আফ্রিকার মঙ্গোলিয়ায় নোনা বাদায় খোলা মাঠে শক্ত কাদায় বা ছোট ছোট উপকূলীয় জলজ উদ্ভিদের মাঝে দল বেঁধে এক এলাকায় ১০০ জোড়ার মত খোয়াজ পাখি বাসা বানিয়ে একসঙ্গে ৩-৪টি  ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়েপাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। ২৩-২৫ দিনে বাচ্চা ডিম থেকে বের হয়। ৩৮-৪২ দিনের মধ্যে বাচ্চা বাসা ছেড়ে উড়ে চলে যায়।

খোয়াজ পাখি বাংলাদেশের সুলভ পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছর আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে। শীতকালে ভোলার মনপুরা, হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ ছাড়াও রাজশাহীর পদ্মার চর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে দেখা যায়। এ ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারত উপমহাদেশে এদের বিচরণ আছে।

বাংলা নাম: খোয়াজ

ইংরেজি নাম: Pied Avocet

বৈজ্ঞানিক নাম: Recurvirostra avosetta

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুলাই ২০১৯/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়