ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বিপন্ন প্রজাতির সুন্দরী বা গেইলো হাঁস

শামীম আলী চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩২, ১৭ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিপন্ন প্রজাতির সুন্দরী বা গেইলো হাঁস

শামীম আলী চৌধুরী: সুন্দরবনকে প্রকৃতির রানী বললে ভুল হবে না। কেওড়া আর গোলপাতায় ঘেরা সুন্দরবন। ‘আমাদের সুন্দরবন’ বইয়ের লেখক ফরিদী নুমান সুন্দরবনের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে, বিশাল, বৃহৎ, বিস্তীর্ণ, নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ, শ্বাপদ-সংকুল ভয়াল, রোমঞ্চকর, চির রহস্যাবৃত এক বন। পৃথিবীর বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন। সাধারণের কাছে বাদাবনখ্যাত এই বন সত্যিই অনুদঘাটিত এক রহস্যের নাম, অপার বিস্ময়! অসম্ভব-অস্বাভাবিক রূপের আঁধার এই বনকে যিনিই দেখেছেন, তিনিই তার প্রেমে মজেছেন।

একবার ভাবুন তো এমন বর্ণনাময় সুন্দরবনে কার না যেতে ইচ্ছে করে? আমারও শখ বা সাধ জেগে উঠেছিলো সুন্দর বনের সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখার জন্য। লেখক ফরিদী নুমানের হাত ধরেই প্রথম সুন্দরবন যাই। আমরা সুন্দরী খালের পাশ দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের এক সতীর্থের নজরে পড়ে এই পাখিটি। জীবনের প্রথম দেখলাম পাখিটিকে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় চড়ে বসলাম। ধীর গতিতে নৌকার মাঝি নৌকা নিয়ে পাখিটির দিকে ছুটছেন। দূর থেকেই পাখিটিকে ফোকাস করে একটি শট নেই। তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হই। সবাই পিনপতন চুপ। কারো সঙ্গে কারো কথাবার্তা নেই। আমাদের দেখে পাখিটিও সামনের দিকে পানিতে ভেসে অগ্রসর হতে থাকে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বনের ভিতর ঢুকে যায়। ততক্ষনে আমরা সবাই বেশ কয়েকটি ছবি তুলি। সুন্দরবনের স্থানীয় মাঝি ও জেলেদের কাছে এই পাখি ‘সুন্দরী হাঁস’ বা ‘গেইলো হাঁস’ নামে পরিচিত। যদিও হাঁসের ঠোঁট ও পায়ের সঙ্গে এই পাখিটির কোন মিল নেই, তাই কেউ যেন না ভাবেন এটা হাঁস প্রজাতির পাখি। তারপরও আমি আঞ্চলিক নামটিই ব্যবহার করি।

সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস Heliornithidae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত মাঝারি আকারের ৫৬ সে.মি. দৈর্ঘ্যের একটি জলচর পাখি। এরা খুবই লাজুক স্বভাবের। নিজেদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুন্দরবনে লুকিয়ে থাকে। এদের গলা লম্বা। ঠোঁট মোটা। অনেকটা বাঁকানো ও খুব শক্তিশালী। এদের পিঠ জলপাই-বাদামী। বুক থেকে দেহের নিচের অংশ ফিঁকে-সাদা রঙের। দেহের অন্যান্য পালক জলপাই-বাদামী হয়। পায়ের আঙুলের পাতায় পর্দা এবং লেজে নরম পালক থাকে। সাদা ডোরা চোখের পশ্চাৎ থেকে ঘাড় পর্যন্ত কালো-বাদামী রং দেখা যায়। চোখের পাতা মোটর দানার মতো সবুজ। ঠোঁট উজ্জ্বল হলুদ। পা ও পায়ের পাতা মোটর দানা সবুজ। পা শক্তিশালী ও খাটো। আঙুলে পাতা-পর্দা আছে। পুরুষ ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষপাখির কপাল, গলা ও ঘাড়ের উপরের অংশ কালো। অথচ মেয়েপাখির গলা নিচে  ও ঘাড়ের উপরে সাদা রঙের হয়ে থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা নেই। শুধুমাত্র পুরুষপাখির কপাল ধূসর বর্ণের হয়।

সুন্দরী বা গেইলো হাঁস সুন্দরবনের খাল ও চিরসবুজ বনের হ্রদে বিচরণ করে। এরা বেশিরভাগ সময় একাই থাকে। তবে জোড়ায়ও দেখা যায়। আমাদের দেশে সংখ্যায় খুবই কম। শুধুমাত্র সুন্দরবনের খালে অল্প কয়েকটা দেখা যায়। এরা কাদায় হেঁটে বা অগভীর পানিতে সাঁতার কেটে খাবার খায়। এদের খাদ্যতালিকায় থাকে মাডস্কিপার, ছোট মাছ, জলজ নোনা পোকা, শামুক ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক সময় পানিতে ডুব দিয়ে থাকে বা তড়িৎ গতিতে দৌড় দিয়ে বনের ঝোঁপের ভিতর লুকিয়ে যায়। খাবার শেষে পানির উপর ঝুলন্ত ডালে বসে এরা বিশ্রাম করে। মাঝে মাঝে হাঁসের মত উচ্চ স্বরে ডাকে।

 

প্রজননকালে এদের ঠোঁটের গোড়ায় মাংসের টুকরার মত শিং গজায়। জুলাই থেকে আগস্ট মাস এদের প্রজনন সময়। প্রজননকালে পানি ও কাদা মাটি থেকে ৬-৯ ফুট উচ্চতায় গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে ডালপাল দিয়ে গোল করে কাকের মত নিজেরাই বাসা বানায় ও ডিম পাড়ে। একসঙ্গে ৫-৬টি ডিম পাড়ে। নিজেরাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। পুরুষ ও মেয়েপাখি মিলিতভাবে ছানার পরিচর্যা করে।

পৃথিবীতে এই পরিবারের ৩ প্রজাতির পাখি আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে ১ প্রজাতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে Heliopais sharpe গোত্রের সুন্দরী হাঁস পাওয়া যায়। এরা আমাদের দেশে দূর্লভ আবাসিক পাখি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ‘গেইলো হাঁস’ খুলনা বিভাগের সুন্দরবনে দেখা যায়। সুন্দরবন ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা যায়। এই পাখি বিশ্বে সংকটাপন্ন ও বাংলাদেশে বিপন্ন পাখি হিসেবে বিবেচিত।

বাংলা নাম: সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস

ইংরেজি নাম: Masked Finfoot

বৈজ্ঞানিক নাম: Heliopais personata

লেখক ছবিগুলো সুন্দরবন থেকে তুলেছেন ।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়