ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পুরান ঢাকায় কোরবানি ঈদ উৎসব

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৭, ১২ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুরান ঢাকায় কোরবানি ঈদ উৎসব

১৯০৪ সালের চকবাজার। বর্তমানে এটি নাজিমউদ্দিন রোড নামে পরিচিত

জাহিদ সাদেক : রাজধানীর পুরান ঢাকাবাসী কোরবানির ঈদ পালনে সৃষ্টি করেছে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। তবে কোরবানি ঈদ এই এলাকার মানুষের কাছে ‘বকরি ঈদ’ নামেই বেশি পরিচিত। এর কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ‘বাংলাদেশের উৎসব’ গ্রন্থে লিখেছেন: একশ বা দেড়শ বছর আগে বাংলাদেশে গরু কোরবানি দেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কোরবানি যদি কেউ দিতেন তাহলে খাসি বা ছাগলই দিতেন। ‘বকরা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো গাভী। বকরা আরবি শব্দের বিকৃত রূপ নিয়েছে বকরি। কিন্তু সে সময় গরু যেহেতু কোরবানি দেয়া সম্ভবপর ছিল না। কোরবানি দেয়া হতো ছাগল। তাই বকরি শব্দের অর্থ হয়ে ওঠে ‘ছাগল’।

তৎকালীন বিখ্যাত সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের লেখা ‘আত্মকথা’ গ্রন্থ থেকেও একইভাবে জানা যায় হিন্দু জমিদাররা তখন গরু কোরবানিকে অনুৎসাহিত করতেন। কোরবানি দিতে হতো ছাগল বা বকরি। যে কারণে কোরবানির ঈদ পুরান ঢাকায় ‘বকরি ঈদ’ নামেও পরিচিতি পায়।

জেমস টেলরের মতে, ১৮৩৮ সালে শহরের বণিকদের ভেতর চার-পাঁচজন মুসলমান ও সমসংখ্যক খ্রিস্টান ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন হিন্দু। এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে কোরবানি দেওয়ার মতো সমাজে তত বেশি বিত্তশালী ব্যক্তিও ছিল না। তবে মহল্লা প্রধান বা সরদারের বাড়িতে প্রতি ঈদুল আজহায় একাধিক গরু-ছাগল কোরবানি দেওয়া হতো। তাছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও দৈন্য ছিল লক্ষণীয়। ১৯০৩ সালের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে পাওয়া যায়, মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ছিল মাত্র এক দিন। মূলত সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময়ে ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ধুমধামের সঙ্গে ‘কোরবানি ঈদ’ পালিত হতে শুরু হয়।

অনুপম হায়াতের ‘নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লিখিত ১৯২২ সালের ৩ আগস্টের দিনলিপি ও নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আহসান মঞ্জিলের নওয়াবদের আমলে কোরবানির ঈদ পালনের ব্যাপারে তারবার্তা আসত দিল্লি থেকে। তারপর তা ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হতো শহরে। একবার ঈদুল আজহার চাঁদ দেখা নিয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। সে বছর ঢাকা শহরে প্রায় মহল্লায়ই শুক্র ও শনিবার দুই দিন ঈদের জামাত হয়েছিল।

কোরবানির গরু নিয়ে ‘ঢাকা পুরাণ’ গ্রন্থে মিজানুর রহমান লিখেছেন, একালে যেমন মাঠে-ময়দানে, রাস্তায় রাস্তায় গরুর হাট বসে, সেকালে তেমনটি ছিল না। সেকালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল যেমন কম, কোরবানির পশুর সংখ্যাও ছিল তেমনি সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা যেমন: রহমতগঞ্জ, গাবতলী, রমনা, রেসকোর্স, হোসেনি দালানসংলগ্ন সোয়ারীঘাট, জিঞ্জিরায় গরুর হাট বসত। বিশেষত ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির নামে রহমতগঞ্জের হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ, যা ‘গনি মিয়ার হাট’ নামে পরিচিত। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলত- ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট করো।’ হাটে মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম বাজার থেকে আসত সাদা নাদুসনুদুস গাই গরু। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎকৃষ্টমানের মিরকাদিমের ওই গরু কিনতে আসতেন বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীরা। ঢাকার আদি বাসিন্দা শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সাত দশকে’ লিখেছেন: ‘ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকে দাবড়ে বেড়াতাম পুরো মহল্লায়, কে কত বড় আর কত সুন্দর গরু কিনল দেখার জন্য। ঈদের নামাজের পরই ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেত আমাদের কোন গরুকে কিভাবে ফেলা হলো, কোন গরুকে ফেলতে কত কষ্ট হলো, কোন গরুকে তিন-চারবার ফেলার পরও উঠে দাঁড়িয়ে গেল- এসব দেখার জন্য।’

ঈদের দিনের বর্ণনা পাওয়া যায় জেমস টেলর-এর  লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘ঈদের দিন সকালে গরু নিয়ে যাওয়া হতো বুড়িগঙ্গা নদীতে। শ্যামবাজার ঘাটে গরুর আর মানুষের ঢল নামত।’

পুরান ঢাকাবাসীর কারো কারো মধ্যে ঈদের সকালে কিছু না খেয়ে থাকার রেওয়াজ ছিল, এখনো আছে। কেউ কেউ আবার হাতে বানানো সেমাই খেয়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের জামাতে শরিক হন। দুপুরে রান্না করা কোরবানির মাংস দিয়ে শুরুর হয় আদি ঢাকাবাসীর ঈদ ভোজনপর্ব। হাকিম হাবিবুর রহমান বিশ শতকের শুরুতে উর্দু ভাষায় ‘ঢাকা: পাচাশ বারস পহেলে’ বইয়ে লিখেছেন: ‘কোরবানির ঈদে ঢাকাবাসী কোপ্তা, কালিয়া, কাবাব রান্না করত। দরিদ্র ঘরেও এ সময় নানা ধরনের মাংস রান্নার কথা শোনা যায়।’ তিনি আরো লিখেছেন, কোরবানির মাংস দিয়ে গরিব ঘরেও শিককাবাব তৈরি করা হতো। প্রায় বাড়িতেই কোরবানির ঈদে মাংসের সরবরাহ বেশি থাকায় গৃহিণীরা চেষ্টা করতেন মাংসের নতুন নতুন পদ তৈরি করতে। রসনাবিলাসী পুরান ঢাকায় এ ক্ষেত্রে দারুণ মুনশিয়ানা ছিল। রান্না করা গোশত কীভাবে দীর্ঘদিন রেখে খাওয়া যায়, তার ব্যবস্থাবিধি সেকালের রমণীদের আয়ত্তে ছিল। মাংস শুকিয়ে অথবা গরুর চর্বির মধ্যে বিশেষ কায়দায় মাংস ডুবিয়ে ছয়-সাত মাস পর্যন্ত রাখার রেওয়াজ ছিল, কখনো কখনো যার পরিসমাপ্তি ঘটত মহররমের আশুরার দিন।

কোরবানির দিন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি গরুর রান পাঠানোর বড়লোকি রেওয়াজ তখনো ছিল, এখনো আছে। কোরবানির গরু কেনা ও প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা এখন পুরান ঢাকার চেয়ে নতুন ঢাকায় বেশি হয় বলে একজন পর্যবেক্ষক জানালেন। লালবাগের আদি বাসিন্দা মযহারুল ইসলাম বাবলা জানান, ‘অতীত আর বর্তমানের ঈদ পালনে বিস্তর ফারাক রয়েছে। স্থানীয় আদি ঢাকাবাসী বিত্তবানরা একাধিক গরু কোরবানি দিতেন। একটি গরু একা কোরবানি দেওয়ার মতো মধ্যবিত্তের অভাব ছিল। আর স্থানীয়দের মধ্যে ভাগে কোরবানি দেওয়ার কোনো রেওয়াজ অতীতে ছিল না, আজও নেই। কোরবানি দেওয়া মানুষের সংখ্যা তখন এত ব্যাপক আকারে ছিল না। মিরকাদিমের সাদা গাভীর কদর স্থানীয়দের কাছে আগে যেমন ছিল, আজও তেমনই রয়েছে।’

বংশাল নিবাসী হাসমত আরা বেগম কোরবানির ঈদ সম্পর্কে তাঁর অভিব্যক্তি জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কোরবানির ঈদের অনুষঙ্গ হিসেবে জিলহজ মাসের দুটি নফল রোজা রাখা এবং দোয়া পড়ার প্রচলন রয়েছে। ঈদের খাবার আয়োজনে থাকে কাবাব, কোপ্তা, সুরুয়াসহ আরো বিবিধ।’ কোরবানি ঈদে মেয়ের বাড়ি, বোনের বাড়ি, জামাই বাড়ি, নিকট আত্মীয়দের বাড়ি গরুর রান বিনিময়ের সংস্কৃতি এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে পুরান ঢাকায়।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়