ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পর্নোগ্রাফি : নিষিদ্ধ দুনিয়ার অজানা সত্য

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পর্নোগ্রাফি : নিষিদ্ধ দুনিয়ার অজানা সত্য

হুমায়ূন শফিক: পর্নোগ্রাফিকে সমাজের দুর্ভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপরও এর ব্যবহার অগোচরে, নানামুখী কৌশলে বাড়ছে। এমনকি ড্রইং রুমে রাখা বোকা বাক্সেও এর কৌশলী উপস্থিতি রয়েছে! আধুনিক এই সময়ে এসে আপনি হয়তো ভাবছেন, আগে কি পর্নোগ্রাফি ছিল?

উত্তর হলো, হ্যাঁ। কিন্তু এখন যেভাবে দেখেন সেভাবে ছিল না। অনেক গবেষক মনে করেন, ভিডিও ও ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই পর্নোগ্রাফির প্রচলন ছিল। তাদের ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলা যায় প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ যৌন ইমেজ দেখতে পছন্দ করত।

সান ফ্রান্সিসকোর ক্লিনিক্যাল সেক্সোলজিস্ট এবং থেরাপিস্ট সেথ প্রোস্টারম্যান বলেছেন, যৌনতা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তাদের সম্পর্কেও এর প্রভাব রয়েছে। মানুষ এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী এবং তারা চায় এটা তাদের জীবনে ঘটুক। ধারণা করতে দ্বিধা নেই পর্নোগ্রাফি মানুষের এই চাওয়াকে উসকে দেয়। যদিও পর্নোগ্রাফি সাবজেক্টিভ ব্যাপার। কিন্তু গবেষকরা একে শৈল্পিকভাবে অযোগ্য এবং শুধুমাত্র যৌন উত্তেজনার সহায়ক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

সংস্কৃতির দিক থেকে মানুষের প্রথম ইরোটিক উপস্থাপন কিন্তু পর্নো নয়। সম্ভবত ৩০ হাজার বছর আগে, পালিওলিথিক লোকেরা গর্ভবতী নারীর বড়ো স্তন এবং আটো-সাটো শরীর বানিয়েছিল। নারী মূর্তিটি বানানো হয়েছিল পাথর এবং কাঠ দিয়ে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, এই মূর্তি বানানো হয়েছিল যৌন উত্তেজনার জন্য। যদিও এ নিয়ে তর্ক আছে। অনেকের মতে, সেগুলো ছিল ধর্মীয়। ইতিহাস বলছে, ভিক্টোরিয়ান যুগ পর্যন্ত পর্নোগ্রাফির আধুনিক কোনো ধারণা ছিল না। ১৮৬০-এর দশকে, পতিতাবৃত্তির পুরনো সংজ্ঞাটিকে প্রতিস্থাপিত করে বর্তমান সংজ্ঞা প্রদান করা হয়। ১৮৬৪ সালের মধ্যে আধুনিক সংজ্ঞাটির প্রথম সংস্করণ ওয়েবস্টার অভিধানে প্রকাশ হয়েছিল। তখন কামুক চিত্রগুলো মদ্যপানজনিত আনন্দানুষ্ঠানে গৃহের দেয়ালে সজ্জিত থাকত। এই উদাহরণ পাম্পেইতে বিদ্যমান। যদিও কিছু যৌন কার্যকলাপ নির্দিষ্ট কিছু পূর্ববর্তী আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নিষিদ্ধ ছিল, তবুও ১৮৫৭ সাল অবধি এই ধরনের বস্তু কিংবা চিত্রকলাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে বই, খোদাই কিংবা চিত্র সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

১৮৬০-এর দশকে পম্পেইয়ে খনন চলাকালে প্রাচীন রোমের বেশিরভাগ কামদ শিল্প প্রকাশ্য দিবালোকে উপস্থিত হয়; যা ভিক্টোরিয়ান অর্থাৎ যারা নিজেদের রোমান সাম্রাজ্যের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরাধিকার মনে করেছিল তাদের কাছে তা অত্যন্ত হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারেননি সেইসব খোলামেলা, অকপট চিত্রাবলী নিয়ে কী করবেন? ফলে তারা উচ্চ শ্রেণীর পণ্ডিত বাদে সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছ থেকে সেগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। যাই হোক, ইংল্যান্ড তথা বিশ্বে ১৮৫৭ সালে অশ্লীল প্রকাশনা (Obscene Publications Act) আইন পাসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফিকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে প্রণয়ন করা হয়।

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইউরোপে মুদ্রণ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নগ্নতা এবং শাস্ত্রীয় বিষয়গুলোর পুনরোজ্জীবন মুদ্রণ ইতিহাসের সঙ্গে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিল এবং পৌরাণিক বিষয়ের উপরে অনেক মুদ্রণই পরিষ্কারভাবে যৌন ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। প্রাচীন দেবতাদের প্রেম, বিশেষ করে ওভিডে বিস্তারিত বর্ণিত জুপিটারের প্রেমকাহিনীতে এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে গল্পগুলোর মূখ্য ঘটনা যৌন সঙ্গমকেন্দ্রিক। পনেরো শতকের পরের দিকে প্রাসাদের জন্য বড় তৈলচিত্র এবং সংগ্রাহকদের জন্য ছোট মুদ্রণগুলিতে স্পষ্ট রতিক্রিয়া অথবা নারীদের জননেন্দ্রিয় দেখানো বন্ধ করা হয়। ১৫২৪ সালে ইতালির বিখ্যাত শিল্পী মারকানটোনিও রেমন্ডি, আই মোদি নামক ষোলো রকমের দৈহিক ভঙ্গি বা যৌন ভঙ্গির চিত্রিত একটি বই প্রকাশ করেন। ফলস্বরূপ ষোড়শ শতকে কামদ বিষয়বস্তুর মুদ্রণের প্রয়াস এক ধরনের কলঙ্কের সৃষ্টি করে। এরপরই পোপ সপ্তম ক্লেমেন্ট রেমন্ডিকে কারাগারে বন্দী করেন এবং বইটির সমস্ত মুদ্রণ নষ্ট করে ফেলার আদেশ দেন।

সতেরো শতকে অগণিত পর্নোগ্রাফি অথবা কামদ সাহিত্যের প্রচার শুরু হয়। যার অন্যতম উদাহরণ হলো ল’ইকোলে দেস ফাইলস, ১৬৫৫ সালে মুদ্রিত এই ছবিটি একটি ফরাসি কাজ এবং ফ্রান্সে এটিকে পর্নোগ্রাফির সূচনা বলে মনে করা হয়। দুই নারীর মধ্যবর্তী সচিত্র কথোপকথন দিয়ে গঠিত এই মুদ্রণে দেখা গেছে, একটি বছর ষোলোর মেয়ে এবং তার এক অভিজ্ঞ বোনের যৌনতা সম্বন্ধীয় বিস্তারিত আলোচনার কথা। এই সময়কার লেখকেরা অজ্ঞাত পরিচয়েই রয়ে গেছেন। নবজাগরণের সময়ে অনেক ফরাসি মুক্ত-চিন্তাবিদ সামাজিক সমালোচনা এবং ব্যঙ্গচিত্র আঁকার মাধ্যমে পর্নোগ্রাফিকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন। লিবার্টিন পর্নোগ্রাফি একটি বিধ্বংসীকর সামাজিক ভাষ্য ছিল এবং ক্যাথলিক গির্জা ও যৌন নির্যাতনের সাধারণ ধারণাই ছিল সেগুলির লক্ষ্যবস্তু। জনগণ দ্বারা সৃষ্ট, সস্তা প্রচারপত্রের বাজার খুব শীঘ্রই বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্তর্গত হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডে যেমন উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়, সেসময়ে বিশেষত নারী, ক্রীতদাস এবং অশিক্ষিতদের থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নৈতিকতা ও দুর্বল মনোভাব কলুষিত হয়ে পড়ে। গল্প এবং চিত্রগুলো প্রায়শই ধর্মবিরোধী ছিল এবং পুরোহিত, সন্ন্যাসী এবং সন্ন্যাসিনীদের দুর্ব্যবহারে ভরা ছিল। ফরাসি পর্নোগ্রাফিতে এই ঐতিহ্য ২০ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত টিকে ছিল।

পর্নো আমাদের কি এমন কাজে লাগে! প্রশ্নটাই স্ববিরোধী। হয়তো লোকের কাছে বলবেন, পর্নো দেখবেন না। আপনার ক্ষতি হবে। অনেক নারীবাদী বলেন, পর্নোসিনেমা নারীদের ছোট করে। তাদের যৌন হেনস্তার পথে পাঠিয়ে দেয়। আবার চিকিৎসকরা বলেন, পর্নোগ্রাফিতে অভিনয় করার জন্য একধরনের ওষুধ সেবন করা হয়। যা যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। পর্নো-ফিল্ম কিন্তু সাধারণ সিনেমার মতোই। এই সিনেমাগুলোতেও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করে। হয়তো আপনারা ভাবছেন সত্যি সত্যি ব্যাপারটা। তা নয়। রেসলিং-এর মতো তারাও অভিনয় করে আপনাদের উপভোগ করার সুযোগ দেয়। এক পর্নোস্টার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন(তিনি নাম প্রকাশ করেন নি), আমিও অভিনয় করি, হলিউডেও অনেকে অভিনয় করে। কিন্তু তাদের খুবই সম্মান দেখানো হয়, কিন্তু আমি ঘরের বাইরেই যেতে পারি না।

পর্নোগ্রাফি এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এটি ধারণা করার জন্য এটুকু জানলেই যথেষ্ট যে, দুনিয়ার সবচেয়ে লাভজনক এবং সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে এটি। স্ট্রিট প্রস্টিটিউশন, স্ট্রিপ ক্লাব, ফোন সেক্স সবই এর অন্তর্ভুক্ত। বছরে এখন ১৩ হাজার অ্যাডাল্ট ভিডিও তৈরি করা হয়। এবং প্রায় ১৩ বিলিয়ন মুনাফা হয়। যদি হলিউডের সঙ্গে তুলনা করি, হলিউডে বছরে ৫০৭টা সিনেমা বানানো হয় এবং লাভ হয় প্রায় ৮.৮ বিলিয়ন। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল ফুটবল লিগ, ন্যাশনাল বাস্কেটবল এসোসিয়েশন ও মেজর লিগ বেসবল এবং এনবিসি, সিবিসি, এবিসি’র চেয়ে বেশি লাভ করে এই ইন্ডাস্ট্রি।

আপনি হয়তো এখন আর অবাক হবেন না এই তথ্য জেনে- প্রতি সেকেন্ডে তিন কোটিরও অধিক ইউনিক ভিজিটর পর্নোগ্রাফি দেখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, এই মুহূর্তেও তিন কোটিরও অধিক ভিজিটর এটি দেখছে বিশ্বজুড়ে। ইন্টারনেটের প্রায় অর্ধেক বিষয় পর্নো সম্পর্কিত। মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বেশিরভাগ লোক ১০ বছর বয়সেই এর প্রতি আসক্ত হয়। এবার আসুন জেনে নেই যারা এই ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় করে তারা কত উপার্জন করে। পুরুষ পারফর্মাররা বেশি আয় করতে পারে না। যদি গে-পর্নে অভিনয় করে তাহলে একটা সিনেমার চেয়ে তারা তিনগুণ বেশি টাকা পায়। পর্নোগ্রাফি ডিভিডি এবং ওয়েব ম্যাটেরিয়াল সবচেয়ে বেশি প্রডিউস করে আমেরিকা; তারপরেই রয়েছে জার্মানি। প্রকৃতপক্ষে, ইউনাইটেড স্টেটে প্রতি ৩৯ মিনিটে একটি নতুন পর্নো ফিল্ম তৈরি করা হয়।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়