ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘এই দোকানের দোকানদার নাই’

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 ‘এই দোকানের দোকানদার নাই’

মহিউদ্দিন অপু: ‘এই দোকানের দোকানদার নাই। খলিফা হুজুরের আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে দোকানটি। কোনো পণ্যদ্রব্য কারো প্রয়োজন হলে নির্ধারিত মূল্য তালিকা দেখে মূল্য পরিশোধের নির্ধারিত বাক্সে মূল্য পরিশোধ করে যে কেউ পণ্যদ্রব্য নিয়ে যেতে পারেন এখান থেকে।’ কথাগুলো বলছিলেন, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে মির্জাগঞ্জ মাজারে খাদেমের দায়িত্ব পালন করা মো. নজরুল।

নজরুল আরো বলেন, ‘এখানে প্রতিবছর ২৪ ও ২৫শে ফাল্গুন মাহফিল হয়। মাহফিলে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা আলেম ওলামাগণ ওয়াজ নসিহত করেন। লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন। এছাড়া মাজার জিয়ারত করতে দূরদূরান্ত থেকে অগণিত ভক্ত এখানে ছুটে আসেন প্রতিদিন।’ এসময় মাজার ও মাজারের সততা স্টোর ছাড়াও মাজার নিয়ে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনার কথাও জানান তিনি।

শতবছরের ঐতিহ্য উপকূলীয় পটুয়াখালী জেলাধীন মির্জাগঞ্জের হযরত ইয়ার উদ্দিন খলিফা (রঃ) এর মাজার। কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ ধ্বনিতে মুখরিত থাকে এই মাজার। দুনিয়া ও পরকালে শান্তি কামনা করে এখানে প্রতিদিনই দূরদূরান্তর থেকে ছুটে আসেন অগণিত মানুষ। কথিত আছে, এ দরবারে কোনো মানত করলে ও মাজারের পাশে নদীতে গোসল করলে মানত পূর্ণ হয়। তাই অনেকেই তাদের মানত নিয়ে ছুটে আসেন এখানে।

মীর্জাগঞ্জের সাধক মরহুম হযরত ইয়ার উদ্দিন খলিফা সম্পর্কে জানা যায়, শরিয়তপুর জেলার পালং থানার ধামসি গ্রামের খাঁ বাড়ির সন্তান তিনি। প্রকৃত নাম ইয়ার উদ্দিন খাঁ। পিতার নাম সরাই খাঁ। তবে তাঁর জন্মতারিখ আজও কেউ সঠিক জানতে পারেননি। ৩৮ বছর বয়সে তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্ত্রী ও ছেলে হারানোর শোক ভুলতে বেশিরভাগ সময়ই মসজিদে থাকতেন এবং জায়নামাজে বসে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। তবুও তার মনে স্বস্তি ফেরেনি। একপর্যায় শোকে পাথর হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। কথিত আছে, তৎকালীন নৌকাযোগে শরীয়তপুর থেকে তিনি মির্জাগঞ্জে এসে উপস্থিত হন। সেখানে নিজ হাতে জামা, টুপি সেলাই করতেন। এ কারণে স্থানীয় লোকজন তাকে ইয়ার উদ্দিন খলিফা নামে ডাকতে শুরু করেন এবং আস্তে আস্তে এই নামেই পরিচিত হন। 

আরো জানা যায়, কর্মজীবনে তিনি মীর্জাগঞ্জ, বিঘাই, কাকড়াবুনিয়া, সুবিদখালীসহ বিভিন্ন হাটে নৌকায় গিয়ে দোকানদারী করতেন। এ সময় তাঁকে সাহায্য করতেন মীর্জাগঞ্জের মরহুম গগণ মল্লিক। ইয়ার উদ্দিন খলিফা বেশিরভাগ সময় কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে মগ্ন থাকতেন। এ সময় তাঁর দোকানে কেউ কিছু কিনতে এলে তিনি তা দিতেন এবং ইশারায় চটের নিচে টাকা রেখে যেতে বলতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল কেউ তাকে ঠকাবে না এবং সততার সঙ্গে মানুষ লেনদেন করবে। তবে কখনো কখনো অনেকেই এই সরলতার সুযোগে নিতেন। কিন্তু তিনি খাদেমদের নিষেধ করে বলতেন- থাক কিছু বলো না, লোকটা লজ্জা পাবে।

ইয়ার উদ্দিন খলিফার জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে বলে জানা যায়। লোকমুখে আজও এগুলো উচ্চারিত হয়। যেমন ব্রিটিশ শাসনামলে পটুয়াখালী থেকে আমতলীগামী স্টিমারে একদিন দুজন লোক আসার পথে টিকেটের টাকা না দিতে পারায় স্টিমারের কর্মচারীরা তাদের অপমান করে ও মীর্জাগঞ্জ ঘাটে নামিয়ে দেয়। এরপর ওই লোক দুজন মাজারে গিয়ে কান্নাকাটি করে ও মাজার জিয়ারত করে। স্টিমারটি সুবিদখালী থেকে ফেরার পথে মাজারের কাছে শ্রীমন্ত নদীতে ডুবে যায়। পরে স্টিমারটি তোলার জন্য মালিক ডুবুরি পাঠালে ডুবুরিরা পানির নিচে গিয়ে দেখেন একজন লোক স্টিমারের ভিতরে কোরআন পড়ছেন। ঘটনাটি জানার পর স্টিমার কোম্পানির লোকজন তাদের ভুল স্বীকার করে মাজারে মানত করে এবং পরদিন সহজেই স্টিমারটি তারা তুলতে পারে। এই ঘটনার পর থেকে লঞ্চ, স্টিমার বা ইঞ্জিল চালিত নৌকা মাজারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সম্মান প্রদর্শন করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়।

মির্জাগঞ্জ মাজারের হিসাবরক্ষক মো. সোহাগ বলেন, মাজারের সততা স্টোরের বাক্সসহ বিভিন্ন দানবাক্সে মানুষের দেয়া টাকা প্রশাসন পরিচালিত মাজারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়। কোনোপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য মাজারের বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত রয়েছে মাজার কর্তৃক বিভিন্ন স্তরে লোকবল।

মির্জাগঞ্জ মাজার জামে মসজিদের ইমাম মো. আনসার উল্লাহ আনসারী বলেন, আধ্যাত্মিক অলি মরহুম হযরত ইয়ার উদ্দিন খলিফার জীবনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা ও শতবছরের ঐতিহ্য তাঁর এই দরবার শরীফ। খলিফা হুজুরের আদর্শে এখানে যে দোকানটি পরিচালিত হচ্ছে তা সারাদেশের সততা স্টোরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সততা স্টোর ছাড়াও বর্তমানে এখানে এতিমখানা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, মুসাফির খানা, পাকা মসজিদ, মহিলাদের জন্য আলাদা দোয়ার স্থান, রেস্ট হাউজ, বৈঠক খানা, অফিসরুম আছে। এখানে আংশিক খরচে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় অতি সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে। হেফজখানার ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোর্ডিং করা হয়েছে এবং সেখানে বিনামূল্যে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এতিমখানায়ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে সম্পূর্ণ ফ্রি।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়