ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইলিশকাল- চতুর্থ পর্ব

উপকূলে ইলিশের সিন্ডিকেট

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৯, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলে ইলিশের সিন্ডিকেট

রফিকুল ইসলাম মন্টু: দিন আনা দিন খাওয়া জেলে। ইলিশ ধরা পড়লেও ফুরোয় না দীর্ঘশ্বাস! নদী-সমুদ্রে মাছ আছে তো, সময় ভালো। মাছ না পেলে শুরু হয় দুঃসময়। আর মাছ পাওয়াটা নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। তাই কোনো বছর একটু বেশি মাছ পড়লে পরের বছর আবার পুরানো হতাশা। শূন্য হাত। কষ্টের জীবন। বাড়তে থাকে দেনার বোঝা। বছরে বেশ কয়েকটা মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময় কাটিয়ে ঠিক মৌসুমটা এলে যদি মাছ না মেলে তখন কষ্টের শেষ থাকে না। বংশ পরম্পরায় পেশায় থেকেও মানুষগুলো অবস্থা বদলাতে পারছে না। ছেলেমেয়ের আবদার, বউয়ের জন্য বছরে দুখানা শাড়ি, ঘরের খুঁটিনাটি কাজ- সবই তো ইলিশ মৌসুমটার জন্যেই পড়ে থাকে। এর ওপর নিজের দু’খানা লুঙ্গি আর চটিজোড়া বদলানোর সুযোগ আর হয় না।

মৌসুমের শেষে ইলিশ ঘাট ঘুরে দেখেছি, জেলের পকেট শূন্য। সেই ছেঁড়া লুঙ্গি-গামছা, ভাঙা ঘর, আর দেনার বোঝা। জেলের বাবা, তার বাবা, তার বাবা- করে গেছেন জেলেগিরি। কিন্তু বদলাতে পারেননি অবস্থা। মাছধরা যাবে না- কখনো জাটকা মৌসুম, কখনো প্রজনন মৌসুম। কড়া আইন। বছরজুড়ে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জেলের কাঁধে। বিনিময়ে কী পায় একজন জেলে? পূনর্বাসন সহায়তা! সেটা জোটে ক’জনের ভাগ্যে? ইলিশ মৌসুমে আমাদের সামনে বারবার ঘুরেফিরে আসে দুটো সংবাদ শিরোনাম। একটি- ইলিশ পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে, অপরটি- ভরা মৌসুমেও ইলিশের দেখা নেই। যে মানুষটা এত খাটাখাটনি করে ইলিশ ধরে এনে বাজারে হাজির করেন, সরকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির টার্গেট পূরণ করেন, সরকারের সাফল্যে যুক্ত করে দেন আরেকটি পয়েন্ট, সে মানুষটা মৌসুম শেষে কী পেলো? আমাদের খবরের তালিকায় স্থান হয় না তার। 

ইলিশ মৌসুম শেষেই আসল চিত্র বোঝা যায়- কেমন আছেন ইলিশ জেলেরা? কী পেলেন এক মৌসুমে? গত বছর ইলিশ মৌসুমের শেষে ঢালচরে পৌঁছালে প্রথমেই তৈয়ব মাঝির মুখোমুখি হই। ইলিশ ধরা বন্ধের আর মাত্র দু’দিন বাকি। সকলে ব্যস্ত। কেবলই সপ্তাহখানের আগে ইলিশ পড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ইলিশ ধরা বন্ধের নোটিশ জারি। সন্ধ্যেয় জমজমাট আবদুস সালাম হাওলাদার বাজার। তৈয়ব মাঝি আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন, আপনার কাছে অনুরোধ জানাই- আর একটা সপ্তাহ ইলিশ ধরার সুযোগ দেন। দেখেন, ইলিশের পেটে এখনও ডিম নেই। একটা সপ্তাহ পরে বন্ধ করলে কোনো অসুবিধা হবে না। আমি তৈয়ব মাঝির জন্য কিছুই করতে পারিনি। দু’দিন পরেই ইলিশ ধরা বন্ধ।

ইলিশ ধরার শেষ দৃশ্যটা হিসাব নিকাশের। কে কী পেলো? কে কতটা সঞ্চয় করতে পারবে? কে কতটা দেনা শোধ করতে পারবে? শেষ দিনটাতে আবার পুঁজিওয়ালাদের পোয়া বারো। হয়তো সারা মৌসুমে তেমন ব্যবসা হয়নি; দেখা গেল শেষদিনে নিলামে কিংবা নামমাত্র মূল্যে ইলিশ কিনে আড়তদারেরা পাঠায় বড় মোকামে। লাভ অর্ধেক। মানে ২০ লাখ টাকার মাছ পাঠালে ১০ লাখই লাভ। কিন্তু জেলের তাতে লাভ নেই। শেষদিনে তাই তার হিসেবটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ইলিশ ধরার শেষদিনে ঢালচরের আনন্দ বাজার থেকে হাওলাদার বাজার আসার পথে দেখা মাঝি আলী খলিফার সঙ্গে। তার সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটছিলেন জেলে শফিক মাঝি। হাতে মালামাল। ট্রলারে ছিলেন প্রায় আড়াই মাস। ট্রলারের মালামাল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আড়াই মাসে আলী খলিফা পাবেন ৭০ হাজার টাকা। তার দু’ ছেলে মিলে আরও দেড় লাখ টাকা পাবেন। তবে তারা থাকেন আলাদা। শফিক ফরাজীর হিসাব তখনও হয়নি। হাওলাদার বাজারের কাছে আসতে দেখা মো. শাহিন, মো. কাসেম, মো. রিপন ও মো. লিটনের সঙ্গে। প্রায় তিন মাস তারাও ছিলেন নদীতে। বাড়ি দক্ষিণ আইচায়। হিসেব হয়নি তখনও। এদের প্রত্যেকেরই মাঝির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়া আছে। হিসেব নিকাশ করলে খুব বেশি কিছু পাবেন বলে তারা মনে করেন না।

দর হাঁকা, দর ওঠা- এখানেই শেষ। এরপরই জেলের হাত শূন্য। যাদের চেষ্টায় ইলিশ আহরণ আর বাজারজাতকরণ, তাদের দৌড় আসলে মাছঘাটের ওই বাক্স পর্যন্তই। কী মাছ পাওয়া, কী না পাওয়া, সেই ধারদেনা করে, টেনেটুনেই জীবন চালানো! এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। সমুদ্র-নদী থেকে ইলিশ আসে মাছঘাটে। সেখান থেকে স্থানীয় হাটবাজার এবং রাজধানী পর্যন্ত। কিনারে ওঠার আগেই ইলিশের বাজার চলে যায় আড়তদার আর বড় ব্যবসায়ীদের দখলে। নিজেদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে জেলে  মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, আমি মাছ ধরি প্রায় ১৫ বছর। আমি একজন জেলে। আমাদের যে মাছগুলো আড়তদারে নেয়, ঠিকমত তার ন্যায্য দাম দেয় না। মাছ ধরে এই সময়ে আমার অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সারা বছরই টানাটানির মধ্যে, ধারদেনা করেই চলতে হয়। তার এই কথার সঙ্গে যোগ করে মাঝি মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমরা যখন নদীতে মাছ ধরতে নামি, তখন আমাদেরকে অনেক টাকা ঋণ নিতে হয়। আড়তদারদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়, বাইরে থেকে ঋণ নিতে হয়। দোকান থেকে বাকিতে সদাইপাতি নিতে হয়। এগুলো নিয়ে আমরা নদীতে যাই। ইনকাম করতে করতে শেষ সিজনে দেখা যায়, ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা ঋণ থেকে যাই। আবার সমান সমানও থাকি। বেশিরভাগই আমরা ঋণী থাকি। এই বোঝা সারাবছর টানতে হয়।

ইলিশের মৌসুমে জমজমাট থাকা দ্বীপ ঢালচরের অধিকাংশ মানুষ মাছধরা পেশার ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমে বাইরে থেকেও প্রচূর পরিমাণ মাঝি-জেলে সেখানে যায়। কিন্তু সেখানকার সার্বিক অবস্থাটা জানতে পারি মো. নূরুদ্দিন মাঝির কথা থেকে। জেলেদের অবস্থা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, মাছ ধরে আমাদের জেলেদের অবস্থা কোনমতেই বদলাচ্ছে না। এই ঢালচর দ্বীপের ১০০ লোকের মধ্যে ৯৫ শতাংশই জেলে। এদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে, পুঁজি আছে তারা মোটামুটি ভালো আছে। তবে সে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। ২০ শতাংশ কাজ করে, মাছ ধরে, খেয়েপড়ে সমান সমান। বাকি ৬৫-৭০ শতাংশ জেলে সারা বছর দেনার বোঝা কাঁধে নিয়ে বেড়ায়। কোনদিনই তারা দেনা শোধ করতে পারে না। কোন জনমে দেনা শোধ করতে পারবে, তাও জানে না।

মাছধরা পেশার সঙ্গে জড়িত নন, তবে খোঁজখবর রাখেন ঢালচরের বাসিন্দা আনিছুর রহমান। তিনিও স্বীকার করলেন, জেলেরা ইলিশের ন্যায্য মূল্য পায় না। একটু ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আসলে তো এখানে মাছ উৎপাদন ঠিকই হয়। কথায় বলে না- কাউ তলায় কাউ মাঙ্গা। কিন্তু আমাদের এখানে জেলেদের ক্ষেত্রে কথাটা তার বিপরীত। এখানে প্রচুর মাছ জেলেরা ধরে নিয়ে আসে। কিন্তু উপযুক্ত দাম জেলেরা পায় না। এখানে আড়তদারি ব্যবসা এবং কিছু দাদনী ব্যবসা আছে। দাদন দেয়ার কারণে আড়তদারেরা তাদের ইচ্ছামত মাছের মূল্য নির্ধারণ করে। এছাড়া বরিশাল, চাঁদপুর, ঢাকা যে বড় বড় ইলিশ বিক্রয় কেন্দ্রগুলো আছে সেখান থেকে এই দ্বীপাঞ্চলের দূরত্ব অনেক বেশি। যারাই টুকিটাকি বাইরের বাজারে কেনাবেচা করে, এখান থেকে তাদের পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ে। এ কারণেই জেলেরা যে মূল্যটা পাওয়ার কথা, সেটা পায় না।’

ইলিশ ব্যবসা উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। জেলেরা সিন্ডিকেটের বাইরে মাছ বিক্রি করতে পারে না। যেমনটা পটুয়াখালীর দ্বীপ ইউনিয়ন চরমোন্তাজ। সেখানে ইলিশের রয়েছে বড় মোকাম। অসংখ্য ট্রলার ভিড়ে ইলিশ নিয়ে। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ইলিশ বেচাকেনা হয় এখানে। চরমোন্তাজের অন্তত ৪০ ইলিশ ব্যবসায়ী মিলে সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা জেলেদের ওপর অলিখিত আদেশ জারি করেছে, যাতে বলা হয়েছে; সিন্ডিকেটের বাইরের কারও কাছে ইলিশ বিক্রি করা যাবে না। ওই ইউনিয়নের আওতাধীন নদী ও সাগরে ইলিশ ধরা স্থানীয় এবং অন্য এলাকা থেকে আসা সব জেলেদেরই এ আদেশ মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। যে কারণে গলাচিপা, দশমিনা, ভোলাসহ আশপাশের এলাকা থেকে আসা মৎস্য ব্যবসায়ীরা চরমোন্তাজের জলসীমায় মাছ কিনতে এসে বিপাকে পড়ছেন। ভোলা থেকে মাছ কিনতে এসে হয়রানির শিকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা। সমুদ্র-নদীতে ধরা থেকে শুরু করে বড় মাছ বাজার পর্যন্ত সর্বত্রই রয়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব। এ কারণে ক্রেতা পর্যায়ে এসেও মাছের দাম কমে না। গত বছরের চেয়ে এবার ইলিশের দাম তূলনামূলক বেশি। গড়পড়তায় ইলিশ আহরণও গত বছরের তূলনায় অনেক কম।

ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বছরে বছরে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূলীয় জেলেদের অবদানের কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আসুন, এবার ভাবি একটু তাদের কথা- যারা ইলিশ আহরণে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন, কখনো প্রাণ হারাচ্ছেন, আবার কখনো নিজের পরিজনকে ফেলছেন সংকটে। মজাদার ইলিশ যারা পাতে তুলে দিচ্ছেন তাদের কথা ভুলে যাওয়া অন্যায়।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়