ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এক বাড়িতেই ঢাকার ইতিহাস

জাহিদ সাদেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৮, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক বাড়িতেই ঢাকার ইতিহাস

জাহিদ সাদেক : পুরান ঢাকার ২৪ মোহিনী মোহন দাস লেন, ফরাশগঞ্জ। এটিই ঢাকা কেন্দ্রের স্থায়ী ঠিকানা। পরিদর্শকরা যাকে বলছেন- ঢাকার জীবন্ত ইতিহাসের ধারক।

কেন্দ্রের পাঠাগারে ঢুকতেই দেখা গেল, কয়েকজন পাঠক মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন। কেউ বই থেকে নোট নিচ্ছেন। দেয়ালে ঝুলছে ঢাকাবাসীর ব্যবহার্য নানান সামগ্রী, ছবি, দলিল, মানচিত্র ও পুরনো চুন-সুরকির ভবনের নকশা।

কেন্দ্রের দোতলায় রয়েছে অন্তত ১০০ প্রজাতির অর্কিডের বাগান। যা আপনাকে কৌতূহলী করবে, মন ভরিয়ে দিবে। আপনি যান্ত্রিকতার বিষণ্নতা থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মুক্তি পাবেন। ইট-পাথরের নগরে এ যেন একখণ্ড সবুজ ঢাকা। কিছু মানুষের উদ্যোগ ও নিরন্তর শ্রম একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বল উদাহরণ ঢাকা কেন্দ্র।

ঢাকা কেন্দ্রের পটভূমি জানতে চাইলে পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখশ জানালেন উনিশ শতকে শুরুর দিকের কথা। ঢাকার বাইশ-পঞ্চায়েতের সর্দার পেয়ার বখশ সর্দার জন্মেছিলেন ১৮৮৫ সালে, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৩ সালে। ছিলেন সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জের আলোচিত মঞ্চশিল্পী। তার অভিনীত মঞ্চ নাটক দেখতে দূর থেকে দর্শক আসত। পেয়ার বখশ সর্দারসহ অনেকেই তখন নিজস্ব অর্থায়নে খোলা চত্বরে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। ঢাকা কেন্দ্রের ভবনটি এই পেয়ার বখশ সর্দারের ছেলে মাওলা বখশ সর্দারের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে গড়া ‘মাওলা বখশ সর্দার ট্রাস্ট’-এর অংশ।  তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্র একটি পারিবারিক উদ্যোগ। এর পাঁচটি প্রকল্প আছে। একটি হচ্ছে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চা। এরই ফসল ঢাকা কেন্দ্র। এই বাড়ির দোতলায় আছে পাঠাগার। পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশি। এর প্রায় সবগুলোই ঢাকাসংক্রান্ত!’

 

 

ঢাকা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে পাঠাগারটি অজস্র পাঠক, গবেষকের প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছে। এখানকার কার্যক্রম পরিচালিত হয় মাওলা বখশ সর্দার মেমোরিয়াল ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে। ট্রাস্টি হিসেবে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ। তিনি মাওয়া বখশ-এর সুযোগ্য সন্তান। দোতলা বাড়িটির নিচতলায় আছে চক্ষু হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। দোতলায় একটি কক্ষ নিয়ে আছে জাদুঘর।

বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, সেখানে আছে সর্দার পরিবারের ব্যবহৃত নানা রকম মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বিশালাকৃতির টেলিভিশন। টেলিভিশনটি অচল হলেও সেটি দেখার মতো। শেলফের ভেতর আছে ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি হুক্কা। দেয়ালে টানানো আছে প্রায় শতবর্ষী তিনটি জাপানি ঘড়ি। আন্টাঘরের ময়দান বা বাহাদুর শাহ পার্কে যে আন্টা খেলা হতো সেই আন্টা সংগৃহীত আছে ঢাকা কেন্দ্রে। সাজানো আছে বন্দুকের কার্তুজ রাখার চামড়ার ব্যাগ, মোরগ-পোলাওয়ের ডিশ। আলমিরাতে শোভা পাচ্ছে সর্দার পরিবারের সোনা-রূপার জরি দিয়ে তৈরি জামা-কাপড়, বৈদ্যুতিক রেকর্ড প্লেয়ার, পুরনো টেলিফোন সেট। বহুকাল আগের বিভিন্ন মডেলের রেডিও দেখে মুগ্ধ হতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বেতারযন্ত্র, বাতিদানি, কলের গান, ১৮৯৬ সালে তৈরি জমির দলিল, প্রাচীন মানচিত্র, পুরনো ভবনের নকশাসহ অসাধারণ আরো অনেক উপকরণ এখানে স্থান পেয়েছে। পুরনো মানচিত্র যা বুড়িগঙ্গার পাড়ে পত্তন হওয়া সেই নগরের বর্ণিল স্মৃতিচিহ্ন আপনাকে নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে। তখন বসবাসযোগ্যতার নিরিখে আজকের বিশ্বের অন্যতম অনুপযোগী শহরটিকে আপনি মেলাতে পারবেন না।

এ ছাড়া ১৯২০-২১ সালের দিকে বাকল্যান্ড বাঁধের ওপরে তোলা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর জটাধারী একটি রঙিন ছবি এখানে টাঙানো রয়েছে। এসব উপকরণ দর্শনার্থীকে নিয়ে যাবে সুদূর অতীতে। পাশের কক্ষেই সাজানো আছে থরে থরে বই। বইগুলোতে মলাটবন্দী ঢাকার শত বছরের পুরনো ইতিহাস। আছে নানা রকম কাগজপত্র ও আলোকচিত্র। রূপার পানদান ও গোলাপ জলদানি দেখে চোখ জুড়াবে দর্শনার্থীর।

আজিম বখশ জানালেন, ঢাকা বিষয়ক বিশেষায়িত পাঠাগার গঠনের চিন্তা থেকে শুধু এই জাতীয় বইগুলোই সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখানে ঢাকা বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এ ছাড়া ঢাকাবিষয়ক তথ্যসংবলিত পত্রিকা, সাময়িকীর সংশ্লিষ্ট অংশ সংগ্রহ করে একত্রে সন্নিবেশ করা হয়েছে। ঢাকার খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব শ্রীরেবতীমোহন দাস (রায়বাহাদুর) তাঁর ‘আত্মকথা’ শীর্ষক বইটি ত্রিশ-চল্লিশ দশকের বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদককে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কালক্রমে তা ঠাঁই পেয়েছে ঢাকা কেন্দ্রের পাঠাগারে। রয়েছে ১৯১৬ সালের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ‘ঢাকা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা’ নিয়ে প্যাট্রিক গেড্ডেসের লেখা বই। এ ছাড়া ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকদের আরো অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ঠাঁই পেয়েছে এখানে। ঢাকাইয়া ছাদ পিটানি গানের অডিও ক্যাসেট এবং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত ঢাকাইয়া ভাষার নাটক, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বলদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। পাঠকের চেয়ে গবেষকের আনাগোনাই বেশি। গত এক বছরে প্রায় ৪০০ জন গবেষণার জন্য এসেছেন।

 

 

পাঠাগারে দেখা হলো রওফুল ইসলামের সাথে। তিনি ঢাকার মসলিন শাড়ি নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকা কেন্দ্রে তাঁর আসার উদ্দেশ্য এ-সংক্রান্ত বই পাওয়া। এখানে থাকা পুরোনো মসলিন শাড়ির ইতিহাস খুঁজছিলেন তিনি। রওফুল ইসলাম বললেন, এই নগরের কোনো কিছু নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করতে গেলে ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া অসম্ভব। গবেষণার কাজে পাঠাগারে এসেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাদমান। তিনি ঢাকা শহরের মাটি ও তৎকালীন অবস্থা জানতে কাজ করছেন। তাঁর কথা, এমন শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ কোথাও দেখিনি। কেন্দ্রের প্রত্যেক মানুষ যেন সহায়তা করার জন্য মুখিয়ে আছেন।

পাঠাগারের পাশে থাকা ছোট জাদুঘরের বিশেষত্ব হলো, এখানে পুরান ঢাকার বনেদি কয়েকটি পরিবারের ওপর আলাদা করে গ্যালারি আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজী আবদুর রশীদ, ইয়ার মোহাম্মদ খান মজলিশ, ভাওয়াল রাজা, রূপলাল দাস, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ পরিবার। এখানে স্থান পেয়েছে এসব পরিবারের দুর্লভ ছবি, পানের ডিব্বা থেকে শুরু করে রান্নার তৈজসপত্র, হুঁকা, শাড়ি-কাপড়, লবণদানি।

ট্রাস্টের হিসাবরক্ষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এখানে প্রতি মাসে ঢাকার একটি নির্দিষ্ট বিষয় ধরে আড্ডা হয়। সেই আড্ডা রেকর্ড করা হয়। আলোচ্য বিষয় পরে লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক চেয়ারম্যান আজিম বখশ  থাকেন গুলশান। কিন্তু পারিবারিক স্মৃতিবাহী এই কেন্দ্রের টানে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন। সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করেন। বাংলাদেশের যে প্রান্তে ঢাকাকেন্দ্রিক যা কিছু পান, সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি।

রাজধানী ঢাকা। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এই মহানগরী। সেবাকর্মের পাশাপাশি এ  প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে ঢাকা নিয়ে নানামুখী চর্চা। তাই অতীতের বা ইতিহাসের ঢাকা দেখতে চাইলে, যে কোনো অবসরে চলে আসুন ঢাকা কেন্দ্রে।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়