ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

প্রজাপতি হয়ে উড়ছে ‘জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’

মাহমুদ নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতি হয়ে উড়ছে ‘জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’

পাঠকের হিসেবে বলতে অনেকে পারে, তবে পাঠককে নিয়ে বলাটা কতজনে করতে পারে? গল্পতো সেটাই, গল্পের পাঠক গল্পকারের সাথে একই সুতোয় বাঁধা পড়ে। কথা বাড়ালে, কথা বাড়ে। চেরাগের বাতি দপ্ করে নিভে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে। ঠিক যেন কালবৈশাখী। তারপর গল্পের শেষে অনেক গল্প, অনেক কানাঘুঁষা, অনেক জল্পনা কল্পনা, অনেক মতবাদ তেড়ে আসে গল্পকারের কাছে। আর এটাই আমার কাছে ছোটগল্প।

এসব ভাবনা শুধু পাঠক হিসেবে ছোটগল্পকে কেমন পেতে চাই বা বলতে পারেন নিজের খায়েশমাত্র। কেউ জরুরি ভাববে সেটার বিলাসীতাও আমার কাছে নেই। কেননা একেকজনের পাঠরুচি একেক রকম। তবে আমার এমনতর ভাবনাগুলো মিটে গেছে সম্প্রতি পাঠ করা নাহিদা আশরাফীর গল্পগ্রন্থ ‘জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ পড়তে পড়তে।

গল্পগ্রন্থটি পুরোপুরি কয়েকবার পাঠ শেষে আমার মনে হয়েছে, নাহিদা আশরাফী চমক নিয়ে আসেন না, এসেই চমকিয়ে দেন। তিনি যেভাবে একটা গল্পকে কুঁচি কুঁচি করে পাঠকের রস্বাদনের জন্য প্লেটে সাজিয়ে দেন নিজের বোধ ও ভাবের কাঁচিতে, একেবারে অন্যরকম তালবাহানা। মন্ত্র মুগ্ধতায় পাঠকের স্নায়ুবিক উন্মাদনা কখন বেড়ে যাবে নিজেরাও খেয়াল করবে না।

গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘সাদা বাস কালো গাড়ি’। ভাষার আন্তরিকতায় গল্পটি একজন নারীর চাকরিজীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত এবং সমাজের নোংরা মানসিকতাকে বাস্তবতার নিরীখে উজ্জ্বলতর বয়ানসমৃদ্ধতা। এই গল্পের নায়িকা সবিতা টানাপোড়নের সংসারে আর প্রতীক্ষিত ভালোবাসার মানুষ দীপনকে পাবার তাগিদে চাকরিক্ষেত্রে বসের কুকামের লালায় জর্জরিতা। দীপনের ঘরেও তার এক দিদি ছাড়া কোনো আপনজন নেই। সবিতা এমন লালাময় পরিবেশ পরিস্থতি থেকে বাঁচবার আকুতিতে দীপনকে বলে তার দিদিকে যেন সবিতার বাড়িতে সম্বন্ধ নিয়ে আসে, তাদের বিয়ের কথা বলে। একদিন ঠিকই এলো, পাঠক হিসেবে আমিও এমন সময়ে নড়ে বসলাম। হয়তো এটা এযাবতকালে সিনেমা দেখার প্রভাব। কিন্তু ঘটলো আরেক ঘটনা। সবিতার বাবা ঘর থেকে পালিয়েছে ! সে বিয়ে করে নিয়েছে আরেকটা, এই বয়সে। যখন, মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাববার কথা এবং পাঠকের মস্তিষ্কজাত মনটাকে তুলোধোনা করে দেবে যখন পাঠক পড়বে সবিতার বাবা বিয়ে করেছে দীপনের সে একমাত্র বিধবা দিদিকে। এরপরে গল্পের মোড় এলো রাস্তায়- সবিতা কী লোকাল বাসে করে অফিসে যাবে এখন নাকি বসের কালো গাড়ি করে অফিসে যাবে... এখানেই গল্পকার গল্পটি শেষ করেছে। ছোটগল্পের এমনতর দাবি জেনে আসছি। কিন্তু পাঠকের বুক ধড়ানিতো থামেই না। পাঠকের হা-হুতাশা চরমে ঠেকবে এই গল্পটি পাঠের পর। এটাকে গল্পকারের চাওয়াটাকে সার্থক করে তুললেও পাঠকের আকুতি থামে না।

‘বৃষ্টি ও শাড়ির গল্প’।  গল্পটি একজন রিকশাচালক আর একজন নারীর নিকষকালো রাতের আঁধারে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে অস্থিরতার বয়ান। নারীটি এমন দুর্যোগ মুহূর্তে পথঘাট কিছুই দেখছে না। চেনার কথাও আসে না। ভয়াল করাঘাত বুকের ভেতরটাকে আছাড়পাছাড় করছে। এমন একা শুধু রিকশাচালক ছাড়া কেউ নেই রাস্তায়। তদুপরি রিকশাচালক বারবার আড়চোখে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে গল্পের নায়িকা আননের সারা শরীরের দিকে। এদিকে পথটা শেষ হচ্ছে না। বারবার রিকশার চেন পড়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে ভয় আরো খিঁচে যাচ্ছে আননের। এসব পড়ে পাঠক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

‘তালেব বুড়ার বিজয় দর্শন’ গল্পটি পাঠ করে নানা অসহায়, অসঙ্গতি জেনেছি।  তালেব বুড়ার বড়ভাই ছিলেন ভাষা আন্দোলনরত সেদিনের যুবক আর মেজভাই মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো অকুতোভয় বীর জীবন যুদ্ধেও কারো কাছে হাত পাতেননি। তালেব বুড়াও যুবক বয়সে যুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। গল্পটি শুরু হয়েছে তালেব বুড়ার ঢাকায় যাওয়াটাকে কেন্দ্র করে। গল্পের শেষদিকে তালেব বুড়া উৎসুক জনতার সামনে খাবারের প্যাকেটগুলো খুলে পরম তৃপ্তিতে খেতে দিয়েছে রাস্তার ক্ষুধার্ত পথশিশু আর বেওয়ারিশ কুকুরদের। তালেব বুড়ার চোখেমুখে তৃপ্তির আনন্দ, সন্তান বাৎসল্যের সুখ দেখে এঁকে দিচ্ছে আমাদের অসঙ্গতিগুলোকে।

নাহিদা আশরাফীর গল্পের ভাষা পরিশীলিত, ঝরঝরে এবং টানটান উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত পাঠককে নিয়ে যেতে সক্ষম। গল্পের মাঝে ভাষার সফল আন্তঃসংযোগ, শেষপর্যন্ত গল্পকে আরো বেগবান করতে চায়। মানে আরো গল্প জন্ম দেয় প্রতিটি গল্প। ‘পার্সেল’ গল্পে যে পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছেন,তা অসামান্য। যা একজন জাত গল্পকারের পক্ষে সম্ভব। আর ‘ মেয়েটি ও একটি অসম্পাদিত গল্প’ তে একজন লেখক একটা গল্পকে কীভাবে যাপন করেন  সেটার সফল রূপান্তরকরণ। একজন লেখক গল্পের চরিত্রের সাথে সবকিছু করে সবার অদৃশ্যে, সেটি পাঠকরা পড়তে পারবেন রসেকষে। একেবারে নান্দনিকতার খাঁটি মিশ্রণ। ‘জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা’ গল্পে মানুষের জৈবিক চাহিদার নানামাত্রিক ব্যঞ্জনায় গল্পের নায়ক এক সময় নানান প্রতিকূলতায়, একেবারে দিনে এনে দিনে খেতে না পারা পরিবারের সন্তানের জীবনসংগ্রামের চিত্রণ। গল্প ‘বাবার চাদর’ গল্পে সমসাময়িক ঘটনা ফুটিয়ে তুলেছেন সযত্নে। গল্পটিতে বার প্রতি মেয়ের গভীর মমত্বে নতুন ভাব ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে।

গল্পগ্রন্থে মোট চৌদ্দটি গল্প রয়েছে। নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা নয়, এই গল্পগ্রন্থ নতুনত্বে আর গল্প বলার আন্তরিকতায় পাঠকের পাঠতৃষ্ণাকে তৃপ্ততা এনে দেবে নিশ্চিন্তে।

নাম: জাদুর ট্রাঙ্ক ও বিবর্ণ বিষাদেরা

লেখক : নাহিদা আশরাফী

প্রকাশন: পরিবার পাবলিকেশন্স

প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন

দাম: ২৪০ টাকা

প্রকাশ : একুশে বইমেলা, ২০১৯


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়