ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

কিংবদন্তি অন্নপূর্ণা দেবী

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কিংবদন্তি অন্নপূর্ণা দেবী

গেলো বছর ৭ অক্টোবর খুব ধুমধাম করে কলকাতায় পালন করা হলো ৯১ তম জন্মদিন। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেব ভেবেছিলাম কিন্তু বোনের অসুস্থতায় তা আর হয়ে ওঠেনি।

৯১তম জন্মদিনের পর সপ্তাহ পার না হতেই চলে গেলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুযোগ্য মেয়ে পণ্ডিত রবিশংকরের প্রাক্তন জীবনসঙ্গী রাগসংগীতের কিংবদন্তি অন্নপূর্ণা। ১৩ অক্টোবর ভারতের সময় ভোর ৩টা ৫১ মিনিটে বোম্বের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বৎসর। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল এই সোমবার।

অন্নপূর্ণা দেবীর আসল নাম রওশন আরা বেগম। একজন স্বনামধন্য সুরবাহার শিল্পী এবং উত্তর ভারতীয় সনাতনী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু। ১৯২৭ সালের ৭ অক্টোবর চৈতি পূর্ণিমা তিথিতে মধ্য প্রদেশের মাইহারে তার জন্ম।

তার পিতার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে রওশন তার পিতার যোগ্য কন্যা হয়ে ওঠেন এবং হয়ে ওঠেন ভারতীয় কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী। তিনি মুম্বাইতে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছেন অনেক দিন। তার শিষ্যদের মধ্যে হরিপ্রসাদ চৌরসিয়া, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, আমিত ভট্টাচার্য, প্রদীপ বারতসহ অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত।

পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাই আলী আকবর খান ভারতের কিংবদন্তি সরোদ শিল্পী। অন্নপূর্ণা বাবার ছাত্র বিখ্যাত সেতার শিল্পী রবি শঙ্করকে ১৯৪১ সালে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় অন্নপূর্ণার বয়স ছিল ১৪ এবং রবিশঙ্করের বয়স ছিল ২১। তাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যার নাম শুভেন্দ্র শঙ্কর বা শুভ। যাকে অন্নপূর্ণা সেতার বাজানো শেখান। শুভ অল্প বয়সেই মারা যান এবং বর্তমানে তার দুই সন্তান রয়েছে।

১৯৬২ সালে রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদ ঘটার আগে থেকেই বাইরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডিতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ পাওয়াটা ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

নিজের বিবাহ-বিচ্ছেদ নিয়ে অন্নপূর্ণা বরাবরই নীরব ছিলেন। ২০০০ সালে কয়েকটি লিখিত প্রশ্নের উত্তরে এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করেছিলেন।

টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্নপূর্ণাদেবী বলেন, “পঞ্চাশ দশকে আমরা যখন একসঙ্গে বাজাতাম, তখন শ্রোতা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে আমার বেশি প্রশংসা পাওয়াটা পন্ডিতজীর (রবিশঙ্কর) ভালো লাগত না। সেটার একটা বিরূপ প্রভাব আমাদের বিয়ের ওপরে পড়ত। যদিও উনি (রবিশঙ্কর) সরাসরি আমাকে অনুষ্ঠানে গিয়ে বাজাতে বারণ করেননি, কিন্তু তাঁর নানা আচরণের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেত - আমি যে এই বেশি হাততালি পাচ্ছি, তাতে উনি বিরক্ত বোধ করছেন।”

“স্বভাবে আমি অন্তর্মুখী, সংসারই আমার কাছে বড়। তাই যশ বা খ্যাতির বদলে বিয়েটাকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।”

অন্নপূর্ণাদেবীর এই আত্মত্যাগ সত্ত্বেও তাঁদের বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। রবিশঙ্করের জীবনে তখন অন্য নারী এসে গেছেন।

বিচ্ছেদ ঘটে যাবার পরেও অন্নপূর্ণা দেবী কেন বাইরের সঙ্গীতজগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন - এর উত্তর অজ্ঞাত। মনে হয় উনি সঙ্গীতসাধনায় যতটা বিশ্বাসী ছিলেন, পরিবেশনায় ততটা নয়। আড়ালে থাকার দরুণ তাঁর সম্পর্কে একটা ঔৎসুক্য ও আগ্রহ অনেকেরই ছিল, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই যে খ্যাতি তাঁর প্রাপ্য ছিল সেটা উনি পাননি।

তবে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অনেকে করেছেন। অন্নপূর্ণা দেবী সম্পর্কে ওস্তাদ আমীর খান বলেছিলেন, “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৮০ শতাংশ পেয়েছেন অন্নপূর্ণা, ৭০ শতাংশ আলী আকবর আর ৪০ শতাংশ রবিশঙ্কর!"

আলী আকবর খাঁ নিজেও সেটা অস্বীকার করেননি। বলেছিলেন, “একদিকে আমাকে, রবিশঙ্করকে আর পান্নালালকে (ঘোষ) বসাও, অন্য দিকে অন্নপূর্ণাকে। পাল্লায় অন্নপূর্ণাই ভারি হবে।”

বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, সে বিচ্ছেদের সূত্র ধরেই সংগীতের ভুবন থেকে হারিয়ে গেছে তাঁর সুর। রবিশঙ্করের সঙ্গে বিরোধের ফলেই অন্নপূর্ণা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবনে আর কখনোই দর্শকদের সামনে সেতার বা সুরবাহার বাজাবেন না। প্রতিজ্ঞায় অনড় থেকে তিনি বেছে নেন মুম্বাইয়ের বাসগৃহে নিভৃত নিঃসঙ্গ জীবন। তাঁর জীবনে আর কোনো দিন রেকর্ডিং করেননি, ৬০ বছরেরও বেশি সময় তিনি বাইরের আলোয় নিজেকে তুলে ধরেননি।

অন্নপূর্ণা ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পদ্মভূষণ লাভ করেন ১৯৭৭ সালে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ছোট ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ'র নাতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মোবারক হোসেন খান এর ছেলে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সরোদ শিল্পী তানিম হায়াত খান রাজিত জানান, অন্নপূর্ণা দেবীর হিন্দুমতে বিয়ে হয়েছিল। তবে, আলাদা করে হিন্দু হননি। কিন্তু বলে গিয়েছেন দাহ করতে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক মোবারক হোসেন খান এর সাথে কথা বলে জানা যায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সফরে বেরিয়েছেন, তার স্ত্রী মদিনা বিবি ছিলেন মাইহারের রাজার উপহার দেয়া বাড়িতে। এমন সময় মদিনা বিবির ঘরে জন্ম নিলো এক কন্যাশিশুর। এসময় রাজ্য জুড়ে চলছিল দূর্ভিক্ষ। অন্নপূর্ণা দেবী হলো সনাতন ধর্ম মতে অন্ন দাতা। তাই মাইহারের রাজা তার নাম দেন অন্নপূর্ণা দেবী। পরে আলাউদ্দিন খাঁ বাড়ি ফিরে মেয়ের নাম রাখেন রওশন আরা খানম। তবে রাজার দেয়া নামটিও বাদ দেননি। তাই নাম হয়ে গেছে রওশন আরা অন্নপূর্ণা দেবী।



কুমিল্লা/জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়