ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যে বিখ্যাত বনগুলো মানুষের তৈরি

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ১৫ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে বিখ্যাত বনগুলো মানুষের তৈরি

বনভূমি। প্রাণ ও প্রকৃতিকে ধারণ করে থাকা দিগন্তবিস্তৃত এক বিশাল সবুজ ভু-খণ্ড। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এক একটি বনভূমি তৈরি হতে সময় নেয় সহস্র বছর। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু বনভূমি রয়েছে যেগুলো প্রকৃতির আশীর্বাদে গড়ে ওঠেনি। সেগুলো গড়ে ওঠার পেছনে মানুষের শ্রম ও প্রচেষ্টা ছিল অনেক বেশি। এগুলোকে বলা হয় ‘ম্যান মেড ফরেস্ট’। একক অথবা একাধিক মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এমন কিছু বনভূমি নিয়ে এই লেখা।

বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রায় বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছিল ব্রাজিলের মাইনাস জিরাইস রাজ্যের ১৭৫০ একরের একটি বনভূমি। তবে এক দম্পতির প্রচেষ্টায় এলাকাটি ফের সবুজ হয়ে উঠেছে। রূপ নিয়েছে মানুষের হাতে গড়া বিশাল এক অরণ্যে। সেখানে ফিরে এসেছে পশুপাখির দল। ব্রাজিলের অধিবাসী এই দম্পতি দীর্ঘ ২০ বছর পরিশ্রম করে অসাধারণ এই কাজ করেছেন। নাম  সেবাস্তিয়াও সালগাদো এবং তার স্ত্রী লেলেয়া ডেলুইজ ওয়ানিক সালগাদো। সেবাস্তিয়াও পেশায় চিত্রসাংবাদিক। পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৪ সালে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরে এসে তিনি অবাক হন। কারণ ছোটবেলায় যখন সে এলাকা ছেড়ে গিয়েছিল তখন এলাকাটি সবুজে আবৃত ছিল। আর এখন তা রূপ নিয়েছে বিরাণভূমিতে। তখন তিনি ও তার স্ত্রী মিলে সংকল্প করলেন হারিয়ে যাওয়া সবুজ ফিরিয়ে আনবেন। ১৯৯৮ সালে দুজনে মিলে গড়ে তোলেন ইনস্টিট্যুটো টেরা নামে একটি দাতব্য পরিবেশবাদী সংস্থা। সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দুই যুগের চেষ্টায় এই দম্পতি রোপণ করেন ৪ লাখের মতো গাছ। ফলাফল বিরাণভূমি পরিণত হয়েছে ১৭৫০ একরের একটি বনভূমিতে। বর্তমানে এই বনভূমি ৩০০ প্রজাতির গাছ, ১৭০ প্রজাতির পাখি, ৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পনেরো প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাসস্থল।

অসাধারণ এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই দম্পত্তি বহু দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ব্রাজিল সরকার বনটিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করেছে।

চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুষ্ক বালুময় প্রান্তর। সেই ঊষর প্রান্তর কোনো এক জাদুর কাঠির স্পর্শে একদিন পরিণত হলো এক টুকরো সবুজে। কালের আবর্তনে সেই ছোট্ট সবুজ জায়গাটিতে গড়ে উঠল বিশাল বন। রূপকথার গল্পের মতো এই শোনানো এই ঘটনাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে কলকাঠি নেড়েছেন যাদব পায়েঙ নামে অতি সাধারণ একজন কৃষক। তার একক প্রচেষ্টায় একটি আস্ত বন গড়ে উঠেছে। তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘অরণ্য মানব’ নামে। যাদবের জন্ম ১৯৬৩ সালে আসামের জোরহাট জেলার মাজুলি দ্বীপের প্রান্তিক মেইসিং উপজাতি সম্প্রদায়ের এক কৃষক পরিবারে। ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে গত চার দশক ধরে তিনি মাজুলি চরে একের পর এক গাছ লাগিয়েছেন। মাজুলিকে পরিণত করেছেন ৫৫০ হেক্টর সবুজ অরণ্যে। তার একক প্রচেষ্টায় এই অরণ্য গড়ে উঠেছে, যা আজ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল।

সদিচ্ছার পাশাপাশি লক্ষ্যে অবিচল থাকলে একজন সাধারণ মানুষও যে অসাধ্যকে সাধন করতে পারেন, যাদব পায়েঙ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া’ বা ‘অরণ্য মানব’ উপাধি দেন। ২০১৫ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন। এছাড়া মাজুলি রিজার্ভ ফরেস্টের নাম বদলে যাদবের ডাকনামের সাথে মিলিয়ে ‘মলাই রিজার্ভ ফরেস্ট’ রাখা হয়।

চীনের গ্রেট ওয়াল বা মহাপ্রাচীরের কথা আমরা সবাই জানি। অথচ গ্রেট গ্রিন ওয়ালের কথা খুব কম মানুষই জানেন। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো দেয়াল বা বৃহদাকার স্থাপনা নয়। এটি হচ্ছে গোটা চীনকে সবুজে ঢেকে ফেলার একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের সুফল হিসেবে চীন পেয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মানুষের তৈরি অরণ্য। ২০১০ সালে চীন সরকার কর্তৃক বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং মরুকরণ রোধে গ্রেট গ্রিন ওয়াল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চীনের সব নাগরিককে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করা হয়। প্রায় এক দশক ধরে চলমান এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তার মোট পতিত ভূমির প্রায় বিয়াল্লিশ শতাংশ জায়গায় গাছ লাগিয়েছে।

তিব্বত মানেই শুষ্ক উচ্চ ভূমি অথবা বরফে ঢাকা প্রান্তর। তবে চীন সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি প্রকল্পের মাধ্যমে তিব্বতের উচ্চভূমির রূপ একেবারেই পাল্টে গেছে। এক সময়ের বিবর্ণ প্রান্তর এখন সবুজে ঝলমল করছে। বনায়ন প্রকল্পটি ১৯৪৯ সালে গৃহীত হলেও এতে জোর দেয়া শুরু হয় ১৯৮১ সালে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিব্বত মালভূমিতে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে গাছ লাগানো হয়েছে। এটি আয়তনে ফ্রান্সের সমান। এই বনসৃজন প্রকল্পের ফলে তিব্বতের স্থানীয় বাসিন্দরা শুষ্কভূমির ধূলি ঝড় থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চাঙ্গা-মাঙ্গাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের তৈরি বন। কিন্তু নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে এটি তার অতীত গৌরব হারাতে বসেছে। ১৮৬৬ সালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক এই বনসৃজন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এটি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরে অবস্থিত। বনভূমির আয়তন প্রায় ১২ হাজার পাঁচশ ১০ একর। জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ এই বনে ৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, ২৭ প্রজাতির সরীসৃপ বাস করে। এই বনটির নাম শুরুতে কিন্তু চাঙ্গা-মাঙ্গা ছিল না। দুই সহোদর ডাকাত ভাইদের কারণে এই বনের নাম হয়ে যায় চাঙ্গা-মাঙ্গা। দুই ভাই প্রায়ই বনের রাস্তার পথিকদের মালামাল লুট করে পালিয়ে যেত।  

 

ঢাকা/মারুফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়