ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিডরের এক যুগ

‘ভাবি এই দিনডা বুঝি জনমের শ্যাষ দিন’

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ১৬ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ভাবি এই দিনডা বুঝি জনমের শ্যাষ দিন’

‘কী হরমু কন? আমাগো কী হরার আছে? বইন্যা আইলে দৌড় দিয়া শেল্টারে (সাইক্লোন সেন্টার) যাওয়া ছাড়া আর কিছুই তো করণের নাই। দিনের মধ্যে একশবার গুরাগারার মুহের দিকে চাই, গুরাগারারে চিন্তায় রাইখা লাভ কি? হেই লাইগা অগোরে মনের চিন্তা কিছুই বুঝতে দেই না। চিন্তা করি এই দিনডাও বিবি-বাচ্চাগো লগে কাডানো এ জনমের শ্যাষ দিন হইতে পারে। যহন বইন্যার কতা হুনি তহন তো বুকের মধ্যে কেমন যেন করে। বুঝাইতে পারমু না...।’

সিডর ও পরবর্তী দিনগুলো নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে কথাগুলো বলছিলেন বরগুনার মাঝেরচরের বাসিন্দা হাবিব মিয়া। সেই মুহূর্তে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল হাবিব মিয়ার চোখে। তিনি পেশায় জেলে। বেশ কিছু দিনের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরতে যখন যান তখন সঙ্গী হয় দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ পারিবার তখন থাকে দুর্যোগ ঝুকিতে।

হাবিব মিয়ার সাথে কথা বলার মাঝেই যোগ দেন হারুন, জাকির, জাফর, রুহুল আমিনসহ আরো অনেকে। বাড়তে থাকে সিডর নিয়ে আলাপ। সিডর পরবর্তী সময় প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ কতটা ভয়ে ভয়ে দিন কাটান তাদের কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তারা তুলে ধরতে থাকেন সমস্যাগুলো। সমাধানের পথগুলোও বাতলে দিলেন তারাই। সিডর নিয়ে কথা শুরু হলেও নানামুখী গ্রামীণ দুর্যোগ নিয়েও হলো আলোচনা। উঠে এলো দুর্যোগসংশ্লিষ্ট গ্রামীণ জনপদের দুর্যোগ ভাবনা ও চালচিত্রের গল্প।

জানালেন, দুর্যোগ পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে খুব ভালো অবগত নন তারা। দেশের প্রচলিত বিপদ সংকেতের অর্থ আজানাই থাকে গ্রাম অঞ্চলের মানুষের কাছে। ৪ নং বা ৬ নং বিপদ সংকেতের মধ্যকার পার্থক্য কী? ১০ নং মহাবিপদ সংকেতের মানে কী? এসব সম্পর্কে অজ্ঞ প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। প্রতিবেদকের কাছে তারা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- চট্টগ্রামে যখন ১০ নং মহাবিপদ সংকেত চলে তখন আমদের এদিকে (মধ্য উপকূলে) ৪ নং সংকেত কীভাবে হলো?

সাইক্লোন শেল্টার নিয়েও অভিযোগ রয়েছে প্রান্তিক জনপদের। তারা জানান, যেখানে স্কুল আছে সেখানে সিডর পরবর্তীতে বেশ কিছু সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও, শেল্টারের সাথে নির্মাণ করা হয়নি সংযোগ সড়ক বা যথেষ্ট রাস্তাঘাট। আবার শেল্টারের ভেতরে নারীবান্ধব আলাদা টয়লেটের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বিপদপূর্ব সময়ে শেল্টারে অবস্থান নিলে খাবার পানির সংকটে ভুগতে হয়। এছাড়া কাথা, বালিশ, কম্বল, পাটি, প্লেট, জগ, গ্লাস, কলসি, খাবার, জামাকাপড় এতসব যদি সাইক্লোন শেল্টারে নিয়ে যেতে হয়, তবে শেল্টারে যাওয়াই এক ঝামেলার ব্যাপার! ফলে প্রান্তিক মানুষ বিপদকালীন মুহূর্তেও শেল্টারে যেতে চান না।

তারা জানান, যেহেতু বন্যার সময় সাধারণত বৃষ্টির কারণে সব কিছুই পানিতে ডুবে যায়, সেহেতু প্রতিটি শেল্টারের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী একাধিক গ্রামের সংযোগ রাস্তা তৈরি করা উচিৎ। পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য মালামাল প্রতিটি শেল্টারে রিজার্ভ রাখা উচিৎ, যাতে এগুলো নিজ বাড়ি থেকে বহন করে নিয়ে যেতে না হয়। নারী শিশু ও প্রতিবন্ধী-বান্ধব টয়লেট ও আলাদা থাকার নির্দেশনা জোরদার করাও জরুরি। প্রতিটি শেল্টারে থাকা উচিৎ সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা।

বন্যা কিংবা জলোচ্ছ্বাসে সেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের প্রতিটি জেলায় উপস্থিত থাকলেও তাদের অবস্থান কেবল শহরকেন্দ্রিক। এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন প্রান্তিক মানুষগুলো। দুর্যোগ এলেই মাইকের যে আওয়াজ শহর অঞ্চলে শোনা যায়, সেই আওয়াজ শোনা যায় না প্রান্তিক পর্যায়ে। ফলে অধিকার বঞ্চিত হবার পাশাপাশি দুর্যোগের পূর্ব-প্রস্তুতি থেকেও পিছিয়ে পরে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো।

বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে অভিযোগ করে তারা বলেন, পর্যাপ্ত বাঁধের অভাব তো রয়েছেই। যতটুকু আছে তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। নদীর স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে কমপক্ষে ১৫-২০ ফুট উচ্চতার বেড়িবাঁধ থাকা জরুরি বলে মনে করছেন প্রান্তিক উপকূলের  এই মানুষগুলো। তারা আরো জানান, স্লুইজগেট থেকে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের মাধ্যমে নোনা পানি ঢুকে উপকূলের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। স্লুইজ গেট খুলে যারা জাল পেতে মাছ ধরে তারা সেগুলো খুলে রাখে, ফলে ক্ষতি হয় কৃষকের। এসব নিয়ে কৃষক কথা বলতে গেলে ঝগড়া বাধে। তাই স্লুইজগেট পরিচালনার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিউন পরিষদের আলোচনার মাধ্যমে স্লুইজগেটের দায়িত্ব প্রতিটি গ্রামের কয়েকজন কৃষককে বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে স্লুইজগেটগুলো জনবান্ধব হয়ে উঠবে।

গ্রামের এই মানুষগুলো নিশ্চিন্ত হয়ে বাঁচতে চায়, দুর্যোগ ঝুঁকি পায়ে ঠেলে এগিয়ে যেতে চায় শহুরে মানুষের মতই। দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নজর দিক গ্রামের দিকে, এমন কামনা প্রান্তিক এই মানুষগুলোর। তারা বলছেন, গ্রাম উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ঝুঁকি প্রতিরোধে শহরে সিদ্ধান্তের সঙ্গী করতে হবে দেশের উপকূলীয় প্রান্তিক গ্রামগুলোকে। তবেই সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে আমাদের সকলের- বাংলাদেশের।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়