ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাবার প্রতি অভিমান ছিল: অনল রায়হান

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাবার প্রতি অভিমান ছিল: অনল রায়হান

শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হিসেবে কলম এবং চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলেন।  কিন্তু পরম কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারেননি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। ব্যক্তিগত জীবনে অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে প্রথম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জহির রায়হান। এ দম্পতির মেজো পুত্র অনল রায়হান। বাবাকে নিয়ে তাঁর ভাবনা, কর্ম, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন এই শহীদপুত্র।  সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো—

রাইজিংবিডি: বাবার কোনো স্মৃতি কী মনে পড়ে?

অনল রায়হান: না, বাবার কোনো স্মৃতি মনে নেই। তবে বাবাকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। একজন মানুষ যখন কাউকে জন্ম দেন, তখন তিনি রক্তের ভেতরে থেকে যান। আট-দশজন সন্তান তার বাবাকে যেভাবে আবিষ্কার করেন সেভাবে আমি পাইনি। বই পড়ে, ছবি দেখে, লোকের মুখে শুনে অর্থাৎ ইতিহাসের ভেতর ঢুকে মানুষটিতে আবিষ্কার করেছি। সবসময় এটাও মাথায় রাখতে হয়েছে-  এটা কি জহির রায়হান? যা অন্য দশজন মানুষের মতো না। পরবর্তীকালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে তাঁর প্রতি আমার অভিমান ছিল। এই অভিমান একান্তই আমার। এগুলো নিয়ে পাবলিকলি কথা বলা যায় না। কারণ তিনি পাবলিক ফিগার।

শিল্পে, রাজনীতিতে তাঁর অবদান হিমালয়তুল্য। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় ব্যাখ্যা করার কোনো কারণ নাই। সুতরাং পিতাকে আবিষ্কারের জায়গা আমার মধুর। আগে বাংলা একাডেমিতে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সামগ্রি নিয়ে একটি প্রদর্শনী হতো। এখন হয় বলে মনে হয় না। ১৯৮৪ সালের দিকে সেখানে আমি একবার গিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে বাবার ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র দেখতে পাই। সেগুলো দেখে বাবার জন্য কেঁদে ফেলি। অটোমেটিক্যালি জিনিসগুলো আমি চিনে ফেলেছিলাম। আসলে এটা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা একটা অনুভূতি। যেখানে আস্তে আস্তে পিতা আবিষ্কৃত হন। বাবার জন্য আমি গর্বিত। এই অনুভূতির তীব্রতা প্রচুর। যতই বয়স বেড়েছে ততই তীব্রতা বেড়েছে।

রাইজিংবিডি: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এ অবস্থায় আপনার প্রত্যাশা জানতে চাই।

অনল রায়হান: আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক একটি দল। এই দলের বাইরে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যারা যে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তার বাস্তবায়ন করতে পারে। এই চারটির মধ্যে একটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। আমরা মার্ক্সসিজম পড়ে বড় হয়েছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেখেছি। সেসব দেশের মতো এটা কিন্তু আওয়ামী লীগও বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কারণ শেষ পর্যন্ত এই দল হলো জাতিকেন্দ্রীক, দেশপ্রেমিক বুর্জুয়া পার্টি। যৌথ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে এই দল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে শুরু করে অর্থাৎ মওলানা হামিদ খান ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু। এই যে একের পর এক নেতা এসেছেন তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের ধারক নন, বাঙালি জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যের ধারক। যেটা খালেদা জিয়া ও বিএনপি কোনো দিনও হবে না। কারণ এগুলো তাদের নীতির মধ্যে নেই। এমনকি বামপন্থি রাজনৈতিক দলও পারবে না।

আমি নিজেও একসময় ওয়ার্কাস পার্টি করেছি। পরিষ্কার বলতে চাই— এরা সব সুবিধাবাদী পার্টি। এরা কখনো নিশ্চিত ছিল না তারা কোন এজেন্ডা নিয়ে এগুবে। আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারে। এরই মধ্যে আমরা কিছু সুফলও দেখেছি। প্রথমত: নিজামীদের ফাঁসি দেয়ার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পেরেছে, তারা (নিজামীরা) হত্যাকারী, ধর্ষক, লুটেরা। এদের ফাঁসি দেওয়া উচিত। এ ফাঁসি বিনএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল দিতে পারত না। সেদিক থেকে এই কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। দ্বিতীয়ত: শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সামনে এসেছে। আশির দশকে দেখেছি- মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাস কেটে দেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন মানুষের ছবি কোথাও দেখা যেত না। তাজউদ্দীন আহমদ, জহির রায়হানের কথা না হয় বাদ দিলাম। এটা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার জন্য। এটা আওয়ামী লীগের মধ্যে আছে। আওয়ামী লীগের এটা ঐতিহ্য।

আমার বাবা দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছেন, সেই সঙ্গে তাঁর মাথায় এটাও ছিল-  দেশ হবে শ্রেণি-বৈষম্যহীন। ধনীদের দেশ হবে না। এমন এক মানবতাবাদী সমাজ ব্যবস্থা হবে যেখানে মানবতাই প্রধান হবে। একজন ব্যবসায়ী নয় বরং কৃষক-শ্রমিক বা একজন উৎপাদনকারীকে সঠিক মূল্যায়ন করা হবে। জহির রায়হানের মতো অনেকের এই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ পঁচাত্তরে যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা না হতো, তবে বাস্তবায়ন হতো। বঙ্গবন্ধুর লেখা বইয়ে এ বিষয়ে আঁচ পাওয়া যায়। একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাকে হত্যা করা হলো। ফলে আপনি পেলেনটা কী? অতীতে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেন। কিন্তু তখন তিনি জামায়াতের বিষয়ে হাত দেননি। অন্যদিকে এ বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অনেকেরই প্রেসার রয়েছে। এত চাপ মাথায় নিয়েই ২০০৮ সালে ব্যাপারটা তিনি সিরিয়াসলি ডিল করেছেন এবং বিচার করেছেন, এখনো চলছে। এজন্য তাঁকে স্যালুট করি। তবে তাঁকে কিন্তু অনেকবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তিনি বেঁচে গেছেন। এখনো শেখ হাসিনার জীবন সংশয় রয়েছে। এই ভদ্র মহিলার যদি কিছু হয়, তবে এই যে অগ্রগতি সেটা থমকে যাবে। তা হবে সবচেয়ে দুঃখের!

রাইজিংবিডি: আপনি চলচ্চিত্র ও লেখক পরিবারের সন্তান। জহির রায়হানের লেখা অনেক গল্প, উপন্যাস রয়েছে। সেগুলো থেকে নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?

অনল রায়হান: পরিকল্পনা নেই, তবে স্বপ্ন আছে। কারণ পরিকল্পনা করার মতো সামর্থ আমাদের কখনো ছিল না। ষাটের দশকে ঢাকা শহরে জহির রায়হান ধনীদের একজন ছিলেন। কারণ তাঁর প্রযোজিত সিনেমা একের পর এক সুপারহিট ছিল। তখন তিনি মরিস অক্সফোর্ড গাড়ি চালাতেন। বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে অডি বা মার্সিডিজ গাড়ির সমমূল্য। সেই মানুষটি কোনো সম্পত্তি ছেলেদের জন্য রেখে যেতে পারেননি। না টাকা, না জমি- কিচ্ছু রেখে যেতে পারেননি। যে জমি কিনেছিলেন সেগুলো তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের নামে বায়না করা ছিল। যা পরে তাঁর (শহীদুল্লা কায়সার) পরিবার আত্মসাৎ করেছে। বাকি যা ছিল তাও মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারকে দান করে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর মরিস গাড়ি নিয়ে কাজী জাফর উল্লাহ পালিয়েছিলেন। সেই গাড়ির হদিসও পাওয়া যায়নি।

বাবা যখন শহীদ হলেন মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসটা আফটার ম্যাথ। ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই ছিল এটা। শুধু যে পরিবারের অর্থ উপার্জনকারী মানুষটাই চলে গেলেন তা নয়, পুরো পরিবারটাই বসে গেল। আমাদের মায়েরা তো ডাক্তার বা বিডিএস পাস করা ছিলেন না যে, স্বামীর মৃত্যুর পর একটা কিছু করে সন্তানদের মানুষ করবেন। আমাদের মায়েদের আশি শতাংশ ছিলেন গৃহিণী। চিন্তা করেন- তারা কতটা অতল গহ্বরে পড়েছিলেন। অনেকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে না; আবার পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। সব মিলিয়ে জলে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। খোঁজ নিয়ে দেখেন, শহীদদের আশি শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছিলেন। আমাদেরও দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমার মাকে ভিক্ষা করতে হয়েছে। মানে প্রযোজক, পাবলিশার্সদের কাছ থেকে টাকা ধার-দেনা করতে হয়েছে। আমি নিজে দেখেছি। মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পাঁচশ, এক হাজার টাকা চেয়ে আনতেন। এরকমভাবে মাকে চলতে হয়েছে। আমার এখনো মনে আছে- বাসায় চাল নাই, দোকান থেকে বাকিতে চাল আনতে হয়েছে। ডাল নাই; ধার করতে হয়েছে। দোকানে বাকি জমে যাচ্ছে, ইলেকট্রিকের বিল জমে যাচ্ছে, মানুষের অপমান ইত্যাদি। এই রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হয়েছি।

তার মধ্যে সরকারের চাপ। জিয়াউর রহমানের সময় আমাদের বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হলো। এরশাদের আমলে আবার উচ্ছেদ করা হলো। এগুলো তো অপমানের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল। এই বিষয়গুলোর উপর দাঁড়িয়ে একটি সন্তান তাঁর বাবার গল্প নিয়ে নাটক-সিনেমা, ডকুমেন্টারি বানানোর ভাবনার অবকাশ রাখে না। এসব রাষ্ট্র বানাতে পারে। তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। শুধু জহির রায়হান নয়, আলতাফ মাহমুদের লেখা নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। আলতাফ মাহমুদের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়া তাঁর লেখা অন্য গানের কথা এই প্রজন্ম জানেই না। বরিশালে আলতাফ মাহমুদের একটি স্কুল রয়েছে। এটি ভঙ্গুর হয়ে গেছে, অন্য লোকে সেটা দখল করে নিচ্ছে— এগুলো তো সরকারের দেখা দরকার। এগুলো তো আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান দেখবে না। আমাদের বাবারা যা দেয়ার দিয়ে গেছেন এবং আমরাও সংগ্রাম করে বড় হয়ে নিজেদের মতো চাকরি করে খাচ্ছি। তবে হ্যাঁ, স্বপ্ন আছে। জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস নিয়ে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী কোহিনূর আক্তার সূচন্দা সিনেমা বানিয়েছেন। এটা না হলে হয়তো বিপুল রায়হান (জহির রায়হানের বড় ছেলে) সিনেমা বানাতেন। ‘তৃষ্ণা’ গল্প নিয়ে আমার ফিল্ম বানানোর স্বপ্ন আছে। ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের প্রযোজনা করার কথা। হয়তো হয়েও যাবে। কিন্তু এটা স্বপ্ন। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার মতো আর্থিক মেরুদণ্ড আমাদের কারোর নেই।

রাইজিংবিডি: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন চলচ্চিত্র আজও নির্মিত হলো না। এমন কেন হচ্ছে?

অনল রায়হান: এর দুটি দিক রয়েছে। এক. মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত না হওয়ার কারণ ওই সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা। পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের চর্চাটাই বন্ধ হয়ে যায়। মৌলবাদী চিন্তা চেতনা সমাজে গেড়ে বসেছিল। তখন গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেয়া, জামায়াতকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হলো। তখনো (আশির দশকে) মঞ্চ নাটকে সাহসী মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে। এটা সত্য। কিন্তু ফিল্ম বানাতে গেলে বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে হয়। ওই সময় কোনো প্রযোজক মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝুঁকি নেননি। পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাটাই যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে চলে গেল তখন বিখ্যাত ক্ল্যাসিক মুভি না হলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্যিক সিনেমা হয়েছে। যেমন: ওরা ১১জন। এটা ক্ল্যাসিক মুভি না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক মুভি। তবে বড় পরিসরে ক্ল্যাসিক মুভি বানানোর সাহস তখন প্রযোজকরা করেননি। কারণ রাজনৈতিক ধারাটাই ওরকম ছিল। আশির দশকে শাবানা-আলমগীরকে নিয়ে সামাজিক-পারিবারিক গল্প নিয়ে অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। নব্বই দশকে এসে অশ্লীল সিনেমার দাপট শুরু হলো। বম্বের সিনেমার কপি-পেস্ট চলল। যা আরো খারাপের দিকে গেল। এর বাইরে ‘গেরিলা’, ‘জয়যাত্রা’ নির্মিত হয়েছে। এগুলো কিন্তু মেইন স্ট্রিম ফিল্ম না। তৌকীর আহমেদ নির্মিত ‘জয়যাত্রা’ কি লক্ষ্মীপুর কিংবা বরিশালের হলে চলেছে? না, চলেনি। ঢাকার কয়েকটি সিনেপ্লেক্সে চলেছে। ‘গেরিলা’ সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। পঁচাত্তরের পরের পাঁচ বছর, আশি, নব্বইয়ের দশকে যারা বড় হয়ে এই প্রফেশনে এসেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধকে আত্মস্থ করে এই প্রফেশনে ঢুকবেন এমন জেনারেশন ছিল না। এখন এই সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আবার দেখুন, মুক্তিযুদ্ধকে বাণিজ্য বানিয়ে ফেলা যাবে না। কিছুদিন আগে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন এক ভদ্র মহিলা (নামটা ভুলে গেছি)। গল্পে এক বাঙালি মেয়ে পাকিস্তানি আর্মির প্রেমে পড়ে। পরে বোধহয় সরকার সিনেমাটি (মেহেরজান) ব্যান করেছিল। ভদ্র মহিলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, মুক্তিযুদ্ধে এত লক্ষ-কোটি গল্প থাকতে এক বাঙালি মেয়ের পাকিস্তানি মেজরের প্রেমে পড়ার মেসেজ এখন দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যে পাকিস্তানি মেজর তাঁর প্যান্টের চেইন খুলে আমার মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, সেই মেজরের প্রেমে একটি বাঙালি মেয়ে পড়লে পড়তেই পারে! লাখ লাখ ঘটনার মধ্যে এটা একটি ঘটনা হতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে ফিল্ম বানানোর কি আছে! 

এজন্য বলছি, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বানানোর ক্ষেত্রেও একটা দৃষ্টিকোণ থাকা দরকার। যে কারণে বিষয়টি জটিলও। চলচ্চিত্র বানানোর ক্ষেত্রে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে। এর কোনো ব্যবসাই এখন নেই। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝুঁকি হয়তো একজন পরিচালক, প্রযোজক নিতে চাচ্ছেন না। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সিনেমা বানাতে যাব না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ওই প্রেক্ষাপট তুলে ধরার জন্য, ওই ফিলিংসটা পর্দায় তুলে আনার জন্য যে পুঁজি দরকার সেটাই পাব না।

রাইজিংবিডি: নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা লালন করছে বলে আপনি মনে করেন?

অনল রায়হান: খুবই অল্প। তারা এখন খুব ক্যারিয়ার সচেতন। তাদের পরিকল্পনা ২০-২৫ বছরে এটা করব, ২৬-২৮ বছরে এটা করব, ৩১-৩৭ বছরে এটা করব, ৪০-৪২ বছরে বাচ্চা-কাচ্চা নিব, ৫০-৫৫ বছরে আমেরিকার সিটিজেন হবো। তারা এখন ‘আমি’ কেন্দ্রীক। যদিও এর মধ্যে অন্যায় কিছু নাই। কিন্তু এই ছেলেমেয়েটি যখন ৫৫ বছর বয়সে আমেরিকায় সেটেল হবে, তখন ওরা শেকড়ের সংকটে পড়বে। এই সংকটের কথাটা এখনই এই ছেলেমেয়েদের বুঝানো দরকার।

এই কাজটা আমার আপনার যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি রাষ্ট্রের। শিক্ষা, তথ্য ও সংস্কৃতি এই তিনটা মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে কোনো কাজই করল না। ধরুণ,  ভিকারুননিসা নূন স্কুলে গিয়ে নবম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীকে ছবি দেখিয়ে বলেন, এটা মুনীর চৌধুরী, এটা শহীদুল্লা কায়সার। তারা এই করেছেন সেই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের হত্যাকাণ্ডের নৃশংস কিছু ছবিও দেখালেন। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীর মনে কোনো রেখাপাত করবে না। তার কারণ স্কুল থেকে বের হয়ে ওই শিক্ষার্থী ক্যাফেতে গিয়ে মোবাইলে এমন বিষয়ে মজে থাকবে যেটা বিপরীত একটা সংস্কৃতি। বিপরীত একটা সময়ের রস। এই রস হলো বর্তমান সময়ের একটা রস। তারা ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকের ভেতরে আছে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীর হৃদয়ের ভেতরে ঢুকতে হবে। আমি ভুলও বলে থাকতে পারি কিন্তু এই বিষয়টি বহুবার বলেছি।

আমাদের কিছু মানুষ এখনো জীবিত রয়েছেন। যেমন: অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনের মতো অনেকে বেঁচে আছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভালো জানেন এবং বিক্রি হয়ে যাননি। এদেরকে এক করে তিনটা মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, তথ্য ও সংস্কৃতি) একটা কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে। এটা দীর্ঘ মেয়াদি হতে পারে। কিন্তু এজন্য মোটা অঙ্কের ফান্ড দরকার। সেই ফান্ড কীভাবে তৈরি হবে তাও আমি বলেছি। দেখুন, প্রধানমন্ত্রীর এখন বয়স হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশে বাস্তবায়নে দ্বিতীয় কোনো নেতা পাওয়া যাবে না। তেমনি আনিসুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুনের মতো যারা আছেন তাদেরও বয়স হয়েছে। তারাও চলে যাবেন। তাঁরা চলে গেলে কে আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবে? কে কর্মসূচি হাতে নিবে? কেউ নিবে না। ফলে নতুন প্রজন্ম নতুন প্রজন্মের মতোই চলবে। আমি নতুন প্রজন্মকে ষাটের দশকের পায়জামা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ানোর কথা বলছি না। একাত্তরে রুমি-বদির যে গেরিলা ফাইটিংয়ের হিরোইজম সেটা যদি ইয়ং ছেলে-মেয়েদের ফিল্মে ভালো করে দেখাতে পারেন, গানে কিংবা নাটকে দেখান অথবা স্কুল-কলেজে পাঠ্যপুস্তকে রাখেন তবে এই ইয়ং ছেলে-মেয়েদের কাছেও রুমি-বদি টম ক্রুজের মতোই হবে। কারণ রুমি-বদির মধ্যে সেই ক্যারিশমা ছিল। কিন্তু এগুলো কে বাস্তবায়ন করবে? অনল রায়হান বাস্তবায়ন করবে, আপনি করবেন? না, এটা সরকারকে করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়ন না হলে একটা শূন্যতা তৈরি হবে। আর এটা হবে যারা ২০০০ সালে জন্ম নিয়েছে তাদের সঙ্গে আমার জেনারেশনের। তাঁরা আমাকে বুঝতেই পারবে না। আমি কথা বলে দেখেছি। তাঁরা আমাকে বলে, মুক্তিযুদ্ধ অতীতের কাহিনি। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমার কিসের দায় পড়েছে সেটা জানতে যাব?

 

ঢাকা/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়