চরামুখা গ্রামে বনবিবির মেলায়
হিম শীতল বাতাসে মিলিয়ে যায় কৃষ্ণা রানী মণ্ডলের উনুনের ধোঁয়া। খানিক জায়গা নিয়ে ছোট্ট চায়ের দোকান। এক কোণে মাটির উনুন। কমলা প্রিন্ট চকচকে কাপড় দিয়ে সাজানো দোকানের চারপাশ। চায়ের সঙ্গে আছে কিছু বিস্কিট আর পান সিগারেট। এতেই বেশ ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকাই কঠিন! গরম উনুন থেকে চায়ের কেটলি থেকে গলগল করে নামছে চা। ভরছে কাপ। যাচ্ছে হাতে হাতে। কৃষ্ণার নেই ফুরসৎ। খানিক দূরে মিষ্টির দোকানে সতীশ ময়রাও সহযোগীদের নিয়ে খুব ব্যস্ত। খেলনাওয়ালাদের দোকানে ভিড় আরও বেশি।
কপোতাক্ষ পাড়ের চরামুখা গ্রাম উৎসবে মেতেছিল সেদিন। দিনটা পহেলা মাঘ। পৌষ মাসের শেষ হতে না হতেই মাঘের প্রথমে জেগে ওঠে এ গ্রাম। হাজারো মানুষের মেলা। বছরের এই দিনটির কথা যেন কাউকে মনে করিয়ে দিতে হয় না। এর নাম বনবিবি মেলা। সঙ্গে বনবিবির পূজা। দিনভর পুঁথিপাঠের মধ্যদিয়ে বনবিবিকে স্মরণ, প্রসাদ বিতরণসহ নানান কর্মকাণ্ড। আর বিকেলে মেলা। নানান পণ্য নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে মেলায় আসেন দোকানীরা। আসে খাবার, খেলনা, মৃৎশিল্পসহ নানাকিছু। মেলার অন্যতম আকর্ষণ খেলাধুলা প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শুধু চরামুখা নয়, কাছেই কয়রার দক্ষিণে ঐতিহ্যবাহী ঘড়িলাল বাজারের নিকটে বসে আরেকটি বনবিবি মেলা। মাঘ মাসের প্রথমদিনে সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বনবিবি পুজা ও বনবিবি মেলা পালিত হয়।
খুলনা বিভাগীয় সদর থেকে কয়রা উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। আর কয়রা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ঘড়িলাল বাজারের অবস্থান। এটি উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের একটি জনপদ। এর এক পাশে সাকবাড়িয়া নদী, অন্যপাশে কপোতাক্ষ নদ। সাকবাড়িয়ার ওপারেই সুন্দরবন। আঁকাবাকা কাঁচা, আধাপাকা আর খানিক পাকা পিচঢালা সড়কে যেতে হয় দক্ষিণ বেদকাশীর সর্বদক্ষিণে। সকালে ঘড়িলাল আর চরামুখা এলাকায় পা রাখতেই এক অন্যরকম আমেজ। ঘড়িলাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে সাজসাজ রব। তৈরি হচ্ছে মঞ্চ, মাঠের চারিদিকে বসছে পণ্যের পসরা। শিশুদের হইহুল্লোড়ে মাতোয়ারা খেলনার দোকানগুলো। একই অবস্থা চরামুখায়। সেখানে কপোতাক্ষ পাড়ে খোলা মাঠে মেলার আয়োজন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পৌষের শেষ এবং মাঘের প্রথম দিনটা এ এলাকার মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ঘরদোর যাতে ঠিক থাকে সেজন্যে পৌষের শেষে বাস্তপূজা করা হয়। আর পহেলা মাঘ করা হয় বনবিবি পূজা। এ দিন দুপুরের দিকে বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসতে থাকে বনবিবি পূজার পুঁথির বয়ান। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িগুলোতে বনবিবি মন্দিরে আয়োজন করা হয় পূজার। পুঁথির বয়ানে বনবিবির কাহিনী বর্ণনা করেন পুরোহিত। ভক্তরা গভীর মনোযোগে শোনেন সে বয়ান। এ উপলক্ষে পায়েস রান্না হয়, প্রসাদ বিতরণ হয়। বনবিবি পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ভক্তরা মন্দিরে ভিড় করেন।
বনবিবির পূজা প্রসঙ্গে বলছিলেন মাটিয়াভাঙা গ্রামের বনবিবি মন্দিরের পুরোহিত শশধর সানা। তার কথায়, পৌরাণিক রীতি অবলম্বনে এই এলাকায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বনবিবি পূজা হয়। পাশাপাশি মেলা হয়। বনবিবি বনদেবতা। বনে গিয়ে যাতে বনজীবীরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে, ভালো আয় রোজগার হয়, সে কারণে আদিকাল থেকে এ পূজা হয়ে আসছে। পুঁথিপাঠ শেষে মন্দিরে প্রসাদ বিতরণ হয়। পরে সকলে মেলায় অংশ নেয়। বনবিবি পূজার গুরুত্ব তুলে ধরে একই মন্দিরে আসা করুণা সানা বলছিলেন, বনে তো রক্ষার আর কেউ নেই। সেখানে আর কেউ নেই। একমাত্র আছেন আমাদের মা বনবিবি। তিনিই রক্ষা করতে পারেন। তাই তার কাছেই প্রার্থনা করি।
চরামুখা গ্রামে সবচেয়ে বড় মেলাস্থলে হাজারো মানুষের ভিড় চোখে পড়ল। কপোতাক্ষ পাড়ের ভাঙা রাস্তা। কোথাও কাঁচা, কোথাও ইট বিছানো। কোথাও বা ভাঙনে রাস্তার অর্ধেকটা হারিয়ে গেছে। গ্রামের বউ-ঝি, মা-খালা, সকলে মিলে মেলায় ছুট। দলে দলে, একজনের হাত ধরে আরেকজন। ঘরের বুড়ো-বুড়িরাও যেন বাদ নেই। চরামুখা গ্রাম হয়ে উঠেছে মুখর। মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। মেলার সামনের রাস্তাটি মোটরবাইকের দখলেই চলে গেছে। সামনে গেট পেরোলেই চোখে পড়ে ‘স্বর্গীয় মধুমাঝি বনবিবি মন্দির’। এই নাম কেন্দ্র করেই এখানে মধুমাঝি বনবিবি পুজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সেই বঙ্গাব্দ ১২৮৩ সাল থেকে। এ হিসাবে এই মেলা ১৩৯ বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
কেউ এসেছেন মেলার খেলাধূলা উপভোগ করতে, কেউবা বনবিবির কাছে কিছু চাইতে। বনবিবি মন্দিরের সামনে নারী-পুরুষের ভিড় লেগেই আছে। বারান্দার বাইরে জুতো রেখে একে একে বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে বের হচ্ছেন। পাশেই করা হয়েছে বাস্তপূজার স্থান। ঘরের ভিটের মত করে সাজানো।
বনবিবি মন্দিরে রয়েছে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী, গাজী আউলিয়া, ছেলে দুঃখী, তার দুই চাচা ধন আর মন-এর প্রতিমা এবং দক্ষিণ রায় তথা ব্যাঘ্রমূর্তি। মন্ত্রপাঠ, নৈবেদ্য ইত্যাদি ধর্মীয় আচারাদির পাশাপাশি প্রসাদ ও শিরনি বিতরণ করা হয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ মনস্কামনা পূর্ণ করতে মানত করেন। ইচ্ছা পূরণ হলে পরবর্তী বছর পূজার দিনে মানত পূরণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বনবিবির কাহিনি শুধুই গল্প, না সত্য, তা নিয়ে বিভেদ আছে। তবে এই কাহিনির কিছু চরিত্র ইতিহাসে বর্তমান। আর এই ইতিহাসের উপাত্ত বনবিবির অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসীদের আরও সংহত করেছে বলে মনে করেন ভক্তরা।
পুরোহিতদের কাছ থেকে পাওয়া বনবিবির পাঁচালি মতে, অনেক বছর আগে সুন্দরবনের পাশের গ্রামের এক দরিদ্র মায়ের শিশু ছেলে দুঃখীকে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে নিয়ে যান ধনে আর মনে নামে দুই ব্যবসায়ী। দুঃখীকে মা বলে দেন, ‘বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছেন। কোনো বিপদে পড়লে তাঁকে ডাকবি। তখন বনে গাজী নামে এক আউলিয়া থাকতেন। দক্ষিণ রায় বাঘবেশী অপশক্তি। গাজীর সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। এক রাতে রায়মণি বা দক্ষিণ রায় ধনে-মনেকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনি দুই ভাইকে প্রচুর মধু আর সম্পদ দেওয়া লোভ দিয়ে দুঃখীকে উৎসর্গ করতে বলেন। অন্যথায় তাদের নৌকা ডুবে যাওয়ার এবং মধু না পাওয়ার ভয় দেখান। ধনে আর মনে ভয়ে দুঃখীকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে পানি আনতে পাঠিয়ে নৌকা ছেড়ে চলে যান। দুঃখী মায়ের কথামতো সেই মাকে স্মরণ করে। বনবিবি এসে দুঃখীকে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে উদ্ধার করেন। তাকে কুমিরের পিঠে ভাসিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। এদিকে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গালী বাঘরূপী দক্ষিণ রায় ও গাজী আউলিয়াকে ধরে বনবিবির কাছে নিয়ে যান। গাজী দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির পক্ষ নেন। এভাবেই পরবর্তী সময়ে বনবিবি সুন্দরবনজীবী মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পান। সেই থেকে শুরু হয় বনজীবী পূজা।
সুন্দরবন লাগোয়া দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দাদের প্রায় সকলেই আদিকাল থেকে বনের ওপর ভর করে বেঁচে আছে। বর্তমানে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমলেই আগে আরও বেশি ছিল। বাঘের ভয়সহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ও ছিল বনজীবীদের। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আদিকালে কেউ একজন বনবিবিকে পূজা দেয়ার বিষয়টি স্বপ্নে পান। সেই থেকে বনবিবি পূজা হয়ে আসছে। চরামুখা ‘স্বর্গীয় মধুমাঝি বনবিবি মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১২৮৩ সালে। মধুমাঝির উত্তরসূরীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মধুমাঝিই বনবিবি পূজার বিষয়টি স্বপ্নে পান। তারই আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বনবিবি মন্দির। স্বর্গীয় মধুমাঝি বনবিবি মন্দিরের বর্তমান সভাপতি ভোলানাথ মাঝি বলেন, মধুমাঝি স্বপ্নে পাওয়ার পর থেকে বংশপরম্পরায় বিষয়টি তাদের কাছে আসে। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ভোলানাথ মাঝির চাচা।
চরামুখা মেলার ভিড়েই দেখা হয়ে গেল দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবি শামসুর রহমানের সঙ্গে। মেলার ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এ এলাকার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এ দিনটির জন্য। এ অনুষ্ঠানের জন্য কাউকে দাওয়াত দিতে হয় না। সকলেই প্রস্তুত থাকে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।
চরামুখা মন্দির থেকে বনবিবি পূজার পর্ব শেষ করেই মানুষজন ঢুকছে মেলার মূল প্রাঙ্গণে। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকাই যেন কঠিন ব্যাপার। অন্যসব মেলার মত এ মেলাতেও শিশুদের খেলনা প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। বড়রা ব্যস্ত ছোটদের বায়না মেটাতে। ছেলে এসেছে বাবার হাত ধরে, মেয়ে ধরেছে মায়ের আঁচল। ভাগ্নে এসেছে মামার হাত ধরে, আর ভাইপো চাচার সঙ্গে। বেলা পড়তে না পড়তে ভিড় যেন বেড়েই যেতে থাকলো। বিশালকায় কুমড়া আকৃতির ব্যাংক বানানো হয়েছে মাটি দিয়ে। ঘোড়া, হাতি, নানান ধরণের পুতুল, বেলুনসহ বহু পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
বনবিবির পূজা উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামীণ মেলায় কৃষ্ণা রানীসহ আর অনেকে এসেছেন দোকান নিয়ে। শুধু কয়রা, খুলনা বা সাতক্ষীরা এলাকা থেকে নয়; আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় পণ্য নিয়ে এসেছেন অনেকেই। মিঠাই-মিষ্টিসহ হরেক রকমের পণ্যে সেজেছে মেলা। অনেক দোকান পরিচালনা করতে দেখা গেল নারীদের। অনেকে চুলো নিয়ে এসেছেন- মিষ্টি, জিলাপি, রকমারি ভাজি পণ্য তৈরি হচ্ছে আর পরিবেশন হচ্ছে গরম গরম। পূন্যার্থীরা বনবিবির উদ্দেশ্যে নৈবেদ্যের পর মেলায় ঘুরে এটা ওটা কিনছে। মেলার শেষপ্রান্তে খেলাধূলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে ছিল অনেক ভিড়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। শীতের রাত জানান দেয় চারিদিকে কুয়াশা ছড়িয়ে। মোটরবাইকের ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। কিছু মানুষ বাড়ির পথে, কিছু আবার কেবলই মেলায় ঢুকলো। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণ আরও উজ্জলতা পায় জেনারেটরের আলোতে। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে মাইকের আওয়াজ। রাত গভীর অবধি বনবিবি জাগিয়ে রাখে প্রত্যন্ত গ্রাম।
ঢাকা/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন