ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলাভাষার ঘরের শত্রু

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাভাষার ঘরের শত্রু

খাজা নাজিমুদ্দিন

শুরু হয়েছে ভাষার মাস। বাঙালীর প্রেরণার মাস। চেতনার মাস। এ মাসের বিশেষণ অনেক। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালী জাতির চির প্রেরণার প্রতীক।

১৯৫২ সালের এদিন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ছিল বীর বাঙালীর মুখে মুখে। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির সেই উত্তাল দিনে গণসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল লতিফ গেয়েছিলেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ এই কালজয়ী গান।

খাজা নাজিমুদ্দিন একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ হয়েও শত্রু ছিলেন বাংলাভাষার। ঢাকার নবাব পরিবারের এই সদস্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলা ভাষার পক্ষ ছেড়ে উর্দু ভাষার পক্ষে তার ভূমিকার জন্য তিনি আজো বিতর্কিত হয়ে আছেন। বায়ান্নর এইদিনে তিনি ভাষা আন্দোলনকারীদের রোষানল থেকে বাঁচতে গভর্নমেন্ট হাউসে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন।

আন্দোলনের মুখে খাজা নাজিমুদ্দিন অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে তিনি মূলত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তার বক্তব্য ও অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য।

খাজা নাজিমুদ্দিন জানান, পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যা বলেছেন তা সবই কায়েদে আজমের কথা, তার নিজের কথা নয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে।’ এটুকু বলেই তাঁর শান্তি হয়নি। তিনি পূর্ববঙ্গবাসীকে আরও জানিয়ে দেন, পাকিস্তানকে তারা ‘এছলামি রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ‘প্রাদেশিকতা’ পাকিস্তানি সংহতির বিরোধী। ভাষা আন্দোলন প্রাদেশিকতাকে উসকে দেবে।

৩ ফেব্রুয়ারির সম্মেলনেও তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রাদেশিকতার বিপদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের বহুকথিত বক্তব্যই তুলে ধরেন।  শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক তার সব বক্তব্যের দায় জিন্নাহর ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেন যে, তিনি জিন্নাহর নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার মাত্র গণপরিষদেরই রয়েছে।

তিনি পরদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। কিন্তু বুঝতে পারেননি যে, গত কয়েক বছরে জমা ক্ষোভের শুকনো বারুদ স্ফুলিঙ্গপাত ঘটিয়ে গেছেন তিনি। কারণ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ সাহেব বাঙালি তরুণদের বাংলা বিষয়ক যে আবেগের ওপর পানি ঢেলে দিয়ে গিয়েছিলেন তা গত কয়েক বছরে বারুদের আকার ধারণ করেছে। সেটা আরো এ জন্য যে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে বাংলাভাষার ওপর আঘাত করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্টা। এ প্রচেষ্টার মূলনায়ক কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গে উর্দু শিক্ষার প্রসার ঘটানোরও চেষ্টা চলেছে।

জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা সত্ত্বেও ছাত্ররা চুপচাপ বসে থাকেননি। যে-যার মত কাজ করে গেছেন। পরিস্থিতি এভাবেই বাংলা ভাষার পক্ষে পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

এটা স্পষ্ট ছিল যে, ৩ ফেব্রুয়ারিতে ডাকা খাজা নাজিমুদ্দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য কোনোভাবেই ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক এ প্রসঙ্গে লেখেন, তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, চার বছর আগে পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ভাষা আন্দোলন তাকে কী সংকটেই না ফেলে দিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে পরিস্থিতির দায় থেকে মুক্তি, তবে পূর্ণ মুক্তি ঘটেছিল তাদের 'কায়েদে আজম'-এর কল্যাণে। তিনি আট দফা চুক্তি খারিজ করে দিয়ে খাজা সাহেবকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। সে ঋণ ভুলে যাবার নয়। এবারও তিনি পরিস্থিতি বুঝে পূর্ব পরিত্রাতার দিকেই হাত বাড়িয়ে দেন।

 

ঢাকা/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়