ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আবার কবে স্কুলে যাবো?

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২৮ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আবার কবে স্কুলে যাবো?

‘আবার কবে স্কুলে যাবো?’- বাবার কাছে প্রশ্ন চতুর্থ শ্রেণীর কিশোর ইসমাইল হোসেনের। প্রশ্ন করতে করতেই তার মনে পড়ে স্কুলের কথা; প্রিয় স্যারের ক্লাসের কথা। মনে পড়ে সব সময় পাশে বসা প্রিয় বন্ধুটির কথা। স্কুলের নানান স্মৃতি আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। পেট ব্যথার অজুহাতে ইসমাইল দু’একদিন ক্লাস ফাঁকি দেয় বটে; তাই বলে এতদিন স্কুলে না গিয়ে থাকা যায়! ইসমাইল বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবার কাছ থেকে প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি ছেলেমেয়েদের অস্থিরতা এভাবেই বেড়ে চলেছে। ক্ষতি হচ্ছে লেখাপড়ায়; বাড়ছে মানসিক চাপ।

করোনাকালে উপকূলীয় জনপদের শিশুদের সামগ্রিক ছবিটা দেখতে গিয়ে এমন গল্পগুলোই উঠে আসে। আলাপ হয় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে না শিশুরা। বাড়িতে পড়াশোনায় অনেকেরই মন বসে না। অনেকের বাড়িতে তেমন পরিবেশও নেই। উপকূলের প্রান্তিকে বহু শিক্ষার্থী রয়েছে; তাদের লেখাপড়া এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায় স্কুল এবং স্কুলের স্যার। স্কুলে যতটুকু পড়ানো হয় ততটুকুই। বাড়িতে পড়ার কোনো প্রচলন নেই অনেক পরিবারে। দ্বীপ-চরের কর্মজীবী পরিবারগুলোতে এই অবস্থা বেশি দেখা যায়। অনেক পরিবার ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায় মৌসুমভিত্তিক। মানে কাজের সময় স্কুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাদের।

করোনা পরিস্থিতি ক্রমে অবনতি হওয়ায় স্কুল বন্ধের ঘোষণা আসে ১৬ মার্চ। প্রথমে দু’সপ্তাহের জন্য, পরে ঈদ পর্যন্ত এ ছুটি বাড়ানো হয়। সারাদেশের মতো উপকূলের প্রান্তিক জনপদের স্কুলও বন্ধ রয়েছে। এর আগে ১০ মার্চ করোনা সংক্রমণ থেকে শিশু এবং স্কুলের রক্ষায় সহায়তা করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি), ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা দেয়। তাদের নির্দেশিকায় বিদ্যালয়কে নিরাপদ রাখতে বলা হয়। শিক্ষাগত সুযোগ-সুবিধার জন্য কীভাবে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং প্রয়োগ করতে হবে; সে বিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেওয়া হয়। স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে, শিশুদের পড়াশোনার এবং সুস্থতার উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব কমানোর সুপারিশ রাখা হয়। অনলাইন শিক্ষার কৌশল ও শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় বেতারের মাধ্যমে সম্প্রচারের মতো দূরবর্তী শিক্ষণ পদ্ধতিসহ শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

শহরের স্কুল থেকে গ্রামের স্কুলে যেমন বিস্তর ফারাক; শহরের শিক্ষার্থী থেকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রয়েছে অনেক ব্যবধান। বলছিলেন ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জামালউদ্দিন। তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ থাকলেও শহরের ছেলেমেয়েরা টেলিভিশন বা অনলাইনের মাধ্যমে নানামূখী শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু গ্রামের বা দ্বীপ-চরের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ নেই বললেই চলে। তার মতে, করোনার কারণে এই লকডাউন প্রান্তিকের শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা দেখা দেবে। 

সরকার এবং ইউনিসেফের ঘোষণা অনুযায়ী, অভিভাবক এবং শিক্ষকেরা বাসায় লেখাপড়ায় জোর দিলেও বাস্তবে ততটা হচ্ছে না। বাবা-মা তাগিদ দিলেও যেহেতু পরের দিন ক্লাসে শিক্ষকের বকুনির ভয় নেই; সে কারণে পড়ায় খুব একটা জোর থাকছে না। বলছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর আবদুল্লাহর বাসিন্দা শফিউল্লাহ। তিনি বলেন, স্কুল খোলা থাকলেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় বসাতে পারি না। এখন স্কুল বন্ধ; মানে ওরা স্বাধীনতা পেয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের দিনের রুটিন পাল্টে যাওয়ার কথা বললেন তেলির চরের শাহীনুর বেগম। তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ থাকা মানে পোলাপাইনের উৎসবের দিন! বইয়ের ধারে কাছেও নেওয়া যায় না। স্কুলে যাওয়ার তাড়া না থাকায় কখন পড়তে বসল, কখন গোসল করল, কখন খাইতে বসল- কোনো ঠিক নাই। বাপমায়ের কথায় কী পোলাপাইন মানুষ হয়?

প্রাথমিক স্তরের শিশুদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখতে অনলাইন ক্লাসের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আওতায় সংসদ টিভিতে ভিডিও ক্লাস কার্যক্রম চালু রয়েছে। চলতি মাসের ৭ তারিখ থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এ ছাড়া ইউটিউবেও রয়েছে ক্লাসের ভিডিও। সংসদ টিভিতে পাঠ্য প্রচারের ঘোষণা দিয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ্ জানিয়েছিলেন এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক পাঠ আয়ত্ব করতে পারবে। কিন্তু দেশব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের চিন্তা বিবেচনায় রেখে এ ধরনের ডিজিটাল ক্লাসের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা উপকূলের প্রান্তিকে ঢেউ তুলতে পারছে না। অন্তত ২০জন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি- কেউই টিভির ক্লাস দেখেনি। অনেকে এ খবর জানেও না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দ্বীপচরের শতভাগ ছেলেমেয়ের কাছে টিভিতে পাঠদানের সুবিধা পৌঁছেনি।

করোনাকালে পড়–য়াদের জন্য টিভি ক্লাস প্রান্তিকের শিশুদের কেন ততটা কাজে আসছে না, এ প্রসঙ্গে বলছিলেন লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের শিক্ষক-সাংবাদিক সানা উল্লাহ সানু। তার ব্যাখ্যা, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ পরিবারে টিভি নেই। এখনও অনলাইনে যুক্ত হতে পারেনি বহু মানুষ। তাছাড়া মুখোমুখি স্যারের কাছ থেকে পড়া শেখা আর টিভির ক্লাস থেকে পাঠ আদায়ের মধ্যে অনেক তফাৎ। উপকূলীয় এলাকার একাধিক জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার জানিয়েছে, তারা করোনার ছুটিকালীন পড়–য়াদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে তাদের দিক থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে উপকূলের প্রান্তিকে সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রামগতির তেলিরচরের আলাউদ্দিন মাস্টার বলেন, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। অনেক ছেলেমেয়ে বইপুস্তক থেকে দূরে সরে যাবে। অনেকে বাড়ির কাজে যুক্ত হয়ে যাবে। করোনার পরে পরিবারগুলোতে অভাব দেখা দিলে তখন ছেলেমেয়েদের কাজে যুক্ত করতে বাধ্য হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন করে ঝরে পড়ার সংখ্যাও বাড়তে পারে। 

প্রান্তিকের শিশুদের আগামী নিয়ে এসব শঙ্কা মিথ্যে হোক। কিশোর ইসমাইল হোসেনসহ সকল শিশুর অস্থিরতা কেটে যাক। ওরা আবার ফিরে পাক আগের জীবন। অপ্রতিরোধ্য দুরন্তপনায় বেড়ে উঠুক প্রকৃতির সঙ্গে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ সব নাগরিকের প্রত্যাশা এমনই।      

প্রথম পর্ব :


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়