ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পেত্রভ:পরমাণুযুদ্ধ থেকে পৃথিবী বাঁচলো যার কারণে

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ১৮ নভেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
পেত্রভ:পরমাণুযুদ্ধ থেকে পৃথিবী বাঁচলো যার কারণে

রাইজিংবিডি২৪.কম:

লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্তানিস্লাভ পেত্রভকে তখন বেশ ঝামেলায়ই পড়তে হয়েছিল। কারণ রাষ্ট্রের অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন না করে তিনি চালিত হয়েছিলেন নিজ সিদ্ধান্তে। কিন্তু পরে প্রমাণ হয়, তার ওই সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। কেননা বিশ্বকে ভয়াবহ এক পারমাণবিক যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

নিজ সিদ্ধান্তে ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকানো সোভিয়েত আমলের ওই সামরিক কর্মকর্তা স্তানিস্লাভ পেত্রভকে (৭৩) সম্প্রতি পুরস্কৃত করেছে ফ্রেন্ডস অব ড্রেসডেন-ডয়েশল্যান্ড নামের একটি জার্মান সংগঠন। যদিও পেত্রভের এ ঘটনা পুরনো এবং দুনিয়াজুড়ে এ নিয়ে আলোড়নটাও আজ হয়ে গেছে অতীত। তবে ঘটনাটি ছিল ভয়াবহ আর মানবজাতির পক্ষে পেত্রভের ভূমিকাটা ছিল এককথায় দুঃসাহসিক আর দায়িত্বপূর্ণ।

সময়টা স্নায়ুযুদ্ধকালের। তখন একদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘স্টার ওয়ার্‌স’ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্টা ব্যবস্থার খোঁজে মরিয়া। ১৯৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। রাজধানী মস্কোর বাইরে সোভিয়েত নিউক্লিয়ার আরলি-ওয়ার্নিং সিস্টেমের কমান্ড পোস্টে দয়িত্বরত ছিলেন লে. কর্নেল পেত্রভ। এর ঠিক একবছর আগে অর্থা‍ৎৎ ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে শাখালিন দ্বীপের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যাত্রীবাহী প্লেনকে ভুলবশতঃ ভূপাতিত করে সোভিযোত এয়ার ডিফেন্স। এনিয়ে দুনিয়াজুড়ে উত্তেজনা তখনো স্তিমিত হয়নি। এমনি এক আবহে ’৮৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের সেদিন সোভিয়েত নিউক্লিয়ার আরলি-ওয়ার্নিং সিস্টেমের কমান্ড পোস্টে একটি মেসেজ আসে; যার অর্থ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছোড়া ৫টি পারমাণু অস্ত্রবাহী মিসাইল ছুটে আসছে সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে। পেত্রভের অন্যতম দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলের বিষয়ে আগাম তথ্য সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা (তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তাই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এবং এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু ছিল)।

পেত্রভের ঊর্ধ্বতনদের দায়িত্ব ছিল এ সংক্রান্ত মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে পাল্টা আঘাত হানা অর্থা‍ৎ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পারমাণবিক মিসাইল ছুড়ে সমুচিত জবাব দেয়া। এর সরল অর্থ— তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। যাহোক, যখন পেত্রভ এ ধরনের রিপোর্ট পেলেন যে, পরমাণু অস্ত্রবাহী ৫টি মিসাইল ছুটে আসছে তার দেশের দিকে— তখন তিনি তার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানকেই কাজে লাগালেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট ওপরে পাঠাবেন না।

বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে তার মনে হল, এটা নিশ্চয়ই কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির ‍কারণে হয়েছে। না হলে এমন হওয়ার কথা না। আর একটি বিষয় হল, যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ৫টি মিসাইল দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় হামলা চালাবে না। কারণ, তারা জানে যে রাশিয়ায় তার মিসাইল আঘাত হানার আগে তার দিকেও ছুটে আসবে অসংখ্য মিসাইল। তাই সামরিক কৌশলগত বিবেচনায়, এ ধরনের ভয়াবহ অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে হলে প্রথমেই চরম এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক অস্ত্রের ব্যবহার করতে চাইবে হামলাকারী। সে বিবেচনায় মাত্র ৫টি মিসাইল দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্র— এ ধরনের সম্ভাব্যতা বাতিল করে দেন মেধাবী সামরিক কর্মকর্তা পেত্রভ।

পরে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর পেত্রভকে পড়তে হয় তোপের মুখে। এ তো জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে ভয়াবহ ছেলেখেলা!

কিন্তু পরবর্তীকালে তদন্তে প্রমাণ হয়, পেত্রভের নিজস্ব বিচার-বুদ্ধিপ্রসূত ধারণা একশত ভাগ সঠিক ছিল। তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, সেদিন আকাশে থাকা অনেক উপরের মেঘের ওপর সূর্যলোকের প্রতিফলনে পর্যবেক্ষক উপগ্রহের সিস্টেম বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং ওই ভুল রিডিং পাঠায়। আর সংশ্লিষ্টরা সত্যাসত্য নিরীক্ষা না করে পেত্রভের ‍কাছে ফরোয়ার্ড করে দেয় পাল্টা আঘাত হানার সম্ভাবনা জাগানিয়া ওই ভয়ঙ্কর মেসেজ।

তবে তদন্তে সত্যাসত্য যাই জানা গিয়ে থাকুক, আর দুনিয়া ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে গেলেও, পেত্রভের বলা যায় কপাল পোড়ে। মেধাবী এই অফিসারের আর প্রমোশন হয়নি। তবে তিনিও চাকরি ছাড়েননি বা কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্তও করেনি; স্বাভাবিকভাবেই তিনি অবসরে যান। বিষয়টি গোপন রাখা হয় ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।

এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে পেত্রভ জানান, ওই ঘটনায় অসাধারণ অবদানের জন্য তাকে পুরস্কৃত করার বিষয়টি ধোপে টেকেনি কারণ, স্যাটেলাইটের ওই ভুল প্রতিবেদনের জন্য দায়ী কর্মকর্তারাই ছিলেন ঘটনার তদন্ত দলের সদস্য অর্থাৎ জগজিৎ সিংয়ের গাওয়া সেই বিখ্যাত গজলের কথার মত, “মেরা কাতিল মেরা মুন্সিফ হ্যায়/ কেয়া ইনসাফ ও মুঝসে কারেগা!” অর্থাৎ ‘‘আমার হন্তারকই আমার বিচারক সেজেছেন, সুতরাং তিনি আর কী ন্যায়বিচার করবেন আমার প্রতি!’’

তবে এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে লে. কর্নেল পেত্রভকে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। যার সর্বশেষ সংযোজন ২৫ হাজার ইউরো মূল্যমানের ড্রেসডেন-প্রেইস বা ড্রেসডেন প্রাইজ (ড্রেসডেন পুরস্কার)।

অবশ্য একের পর এক পুরস্কার পাওয়ার ধারায় ওই সময়টায় তাকে রীতিমত হলিউডি সিনেমার হিরো বানানোর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনের এই নায়ক সেসবে গা ভাসাননি। এ বিষয়ে ২০০৪ সালে মস্কো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অসম্ভব বিনয়ী লে. কর্নেল পেত্রভ বলেন, “আমি সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে শুধুমাত্র আমার দায়িত্বটা পালন করছিলাম।”

এদিকে, যুদ্ধবিরোধী জার্মান এই পুরস্কার কমিটি জানিয়েছে, ড্রেসডেন-পুরস্কার লে. কর্নেল পেত্রভের হাতে তুলে দেওয়া হবে আগমী ১৭ জানুয়ারি ড্রেসডেন-এ বোমাবর্ষণ বার্ষিকীর দিনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এদিন ড্রেসডেনকে শত্রুমুক্ত করতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে মিত্রবাহিনী।

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়