ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

খোকা ও রেণু এক অভিন্ন সত্তা

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ৮ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খোকা ও রেণু এক অভিন্ন সত্তা

কেএমএ হাসনাত : জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে ওঠেননি। অনেক ত্যাগ, তিতীক্ষা আর সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীনস্বত্তা পরিচয়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার মাধ্যমেই তিনি এ আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আর তার এ সফলতার পেছনে যিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি এক মহিয়সী নারী বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

খুবই অল্প বয়সে শেখ মুজিবের সহধর্মিণী হিসেবে প্রতিটি দুর্যোগময় সময়ে পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে গেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা । খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হিসেবে উত্তরণের প্রতিটি স্তরে তিনি ছায়ার মত পাশে থেকেছেন, করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি স্বামীর অনুসারীদের দেখভাল করার সঙ্গে পুরো পরিবারকে আগলে রাখতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু। বঙ্গবন্ধু তাকে রেণু বলেই ডাকতেন।

বেগম ফজিলাতুন্নেছার দুটি সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রাম আর আন্দোলনকে অনেক বেশি বেগবান করেছিল। এককথায় সিদ্ধান্ত দুটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। প্রথমটি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে গোল টেবিল আলোচনায় না বসা। দ্বিতীয়টি, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ।

৬ দফা আন্দোলনকে ঘিরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠি মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা লাগাতে উঠে পড়ে লাগে। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবসহ ৩৫জন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এসময় তিনি বিচলিত না হয়ে আইনিভাবে মোকাবেলা করার জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করেন। এরই মাঝে মুজিবকে গ্রেপ্তার করে প্রহসনের মামলার শুনানি শুরু হয়। এরফলে মুজিবসহ অন্যান্য রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। পুরো পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনের দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।  মুজিবকে বোঝানোর জন্য বেগম মুজিবকে গ্রেপ্তারসহ নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিবাদি পুরো বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে  গণআন্দোলন আরো বেগবান হলে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠি পিছুটানে বাধ্য হয়।

মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছিল এ অবস্থায় স্বৈরসরকার লাহোরে গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এবং শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাতে যোগদানের ঘোষণে দেয়। পাক সরকারের চালাকি ধরতে পেরে বেগম মুজিব কারাগারে গিয়ে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পেছনে শাসকগোষ্ঠি নতুন কোন ষড়যন্ত্র করছে।  গণআন্দোলনের তীব্রতা দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।

শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বেগম ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শে প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাতে অনঢ় থাকেন। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। এরপরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় এক বিশাল সংবর্ধ্বনা সভায় বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই থেকে তিনি বাঙালি জাতির প্রিয় বঙ্গবন্ধু। সেদিন বেগম ফজিলাতুন্নেছা শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি নিতে বাধা না দিলে বাংলাদেশের ইতিহাস কি হতো সেটা ভাবাই যায় না।

’৬৯ এর গণআন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীকারের আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তানের লৌহমানব ফিল্ডমার্শাল আইযুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। তার স্থলাভিষিক্ত হন আর এক সামরিক ব্যাক্তি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি ক্ষমতা নিয়েই দেশে সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দেন।  ১৯৭০ সালের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন পায়। কিন্তু সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করতে থাকে।

এভাবেই এসে যায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এদিন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। এনিয়ে সহকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে নানা ধরনের পরামর্শ দেন। সে সময়ও বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন তিনি সারা জীবন যাদের জন্য রাজনীতি করেছেন তাদের মুক্তির জন্য যা ভাল হবে, সারা জীবন তিনি যা ভেবেছেন তাই যেন বলেন। সেদিনও ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পরামর্শে রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণের মাধ্যমেই  বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা । কার্যত সেদিন থেকেই বাংলাদেশ আলাদা সত্তায় আত্মপ্রকাশ করে।

শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন একজন আর একজনের পরিপূরক। একজনকে আর একজনের কাছ থেকে কোন ভাবেই আলাদ করা যায় না। আমাদের মুক্তির সংগ্রামে এই মহিয়সী নারীর অবদান কোন দিন ভোলার নয়।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা  (রেণু) নামের এ মহীয়সী নারী ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়া জন্মগ্রহণ করেন। ফুলের মতো গায়ের রঙ দেখে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। সেই নামেই সবার কাছে পরিচিত হন তিনি। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা শেখ জহুরুল হক এবং পরে মা হোসনে আরা বেগম মারা গেলে তাদের দায়িত্ব এসে পড়ে  দাদা শেখ আবুল কাশেমের ওপর। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন গভীর মমতায় রেণুকে নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। তার চোখের পানি মাটিতে পড়তে দেননি তিনি।  পিতৃ-মাতৃহারা ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে খেলার সাথী হয়ে বড় হয়েছেন। এর পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে মাত্র ১৩ বছর বয়সে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবনের সাথী হলেও প্রকৃত জীবন সাথী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর এন্ট্রান্স পাস করার পর। বঙ্গবন্ধুর স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁর পিতার সান্নিধ্যে কেটেছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে করাগারে। এসময় ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রলীগকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ অপরাপর ছাত্রনেতার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতেন তিনি। নিজের গহনা বিক্রি করে ছাত্রলীগের সম্মেলনে টাকাও দিয়েছেন। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে আয়কৃত টাকায় তিনি অনেক মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন।

একবার একনাগাড়ে ১৭ থেকে ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় তাঁর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়েছিল। এ অবস্থা দেখে বেগম মুজিব কষ্ট পান। স্বামীকে বলেন, ‘জেলে থাক আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন... তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে? শুনে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি?’

বেগম মুজিব সংসারে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্ট করতেন। কিন্তু স্বামীকে কিছুই বলতেন না। নিজে কষ্ট করে স্বামীর জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখতেন। যাতে স্বামীর কষ্ট না হয়। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীই ছিলেন না। ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথিও।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৮ আগস্ট ২০১৯/হাসনাত/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়