ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা ছিল বঙ্গবন্ধুর

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ১২ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা ছিল বঙ্গবন্ধুর

এম এ রহমান মাসুম : ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ। স্বাধীনতা দিবসের পঞ্চম বার্ষিকী ছিল। সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

ভাষণে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়ে জনগণের সহায়তা চান তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সরকারি আইন করে কোনো দিন দুর্নীতিবাজদের দূর করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একটিমাত্র অনুরোধ আছে আপনাদের কাছে। আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলব বাংলার জনগণকে- এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। গণআন্দোলন করতে হবে। আমি গ্রামে গ্রামে নামব। এমন আন্দোলন করতে হবে যে, ঘুষখোর, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখোর, যে আমার জিনিস বিদেশে চোরাচালান দেয় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে। গ্রামে গ্রামে মিটিং করে দেখতে হবে, কোথায় আছে, ওই চোর, ওই ঘুষখোর। ভয় নাই, আমি আছি। ইনশাল্লাহ, আপনাদের ওপর অত্যাচার করতে দেব না।’

আহ্বান জানালেন দেশ গড়ার নতুন যুদ্ধের। যা ছিল মূলত মার্চে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দীতে দেয়া শেষ ভাষণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কারণ, এরপরে এতো দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেয়ার সময় দেয়নি হায়েনারা। তার অসাধারণ ভাষণটি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। বাংলাদেশ এগিয়ে নেওয়ার চমৎকার সম্ভাবনাময় এই ভাষণটির কথা জানেন না হয়ত অনেকেই।  হয়ত হায়েনারাই ভাষণটি জনসমক্ষে আসতে দেয়নি। এর চার মাস পরেই রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল খুনিরা। এই ভাষণটির অনুলিখন ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ থেকে প্রকাশিত স্মরণিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল।

সেদিন অনলবর্ষী বক্তা বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় উচ্চারণ, ‘কেন সিস্টেম পরিবর্তন করলাম? সিস্টেম পরিবর্তন করেছি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্য। কথা হলো, এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সবকিছু ফ্রি স্টাইল! অফিসে-আদালতে-ফ্যাক্টরিতে কাজ না করে টাকা দাবি করে। সাইন করিয়ে নেয়। যেন দেশে সরকার নাই। আবার, স্লোগান হলো বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। বঙ্গবন্ধু কঠোর হবে। কঠোর ছিল, কঠোর আছে। কিন্তু দেখলাম, চেষ্টা করলাম, এত রক্ত, এত ব্যথা, এত দুঃখ। তার মধ্যে ভাবলাম দেখি কী হয়, কিছু করতে পারি কিনা। আবদার করলাম, আবেদন করলাম, অনুরোধ করলাম, কামনা করলাম, কিন্তু কেউ কথা শোনে না। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী।’

বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিটি ভাষণেই দুনীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি করেছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনেও আবেগাপ্লুত জাতির জনক বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিলেন এভাবে- যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, ঘুষখোরদের আমি ক্ষমা করব না।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা ছিল ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারির ভাষণেও। তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যত তমিস্রায় ছেয়ে যাবে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।

এর আগে ১৯৭২ সালের ৭ ‍জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও বঙ্গবন্ধু কালোবাজারিদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, মুনাফাখোর, আড়তদার ও চোরাকারবারি সাবধান হয়ে যাও। ভবিষ্যতে সোজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাশ করবো তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। 

তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী ভায়েরা আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোররা নয় নম্বর ধারায় চাকরি হারাবে, জেলখানায় যাবে।’

বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বরং সোনার বাংলা গড়তে যুদ্ধের কৌশল ও ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণ। দুর্নীতি এখন অনেকটা কাঠামোগত সমস্যা হয়ে আছে। উপরি কাঠামোতে দুর্নীতি রেখে, নিচে এর সমাধান খুঁজতে চাইলে তা কেবল রসিকতারই জন্ম দেবে। শাসন কাঠামোর উপরিভাগ যদি দুর্নীতিমুক্ত হয়, দুর্নীতি করলে যদি শাস্তি পায়, এবং দুর্নীতিকে দমন করতে যদি আন্তরিক হয় তবেই নিচ কাঠামোর দুর্নীতি এমনিতেই হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাবে।

সমাজে বিশালায়তনের যে দুর্নীতি হয়, তাকে সুরক্ষা দিয়ে, নিচ কাঠামোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্কের দুর্নীতি রোধ করে খুব বেশি লাভ হয় না বলেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সম্ভবত বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বিষয়টি শক্তভাবেই উপস্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন- আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান- করাপশন। খাদ্য কিনতে যান- করাপশন। জিনিস কিনতে যান- করাপশন। বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫% শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি। এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনবো সেই খাবার চুরি করে খাবে, অর্থ আনবো চুরি করে খাবে, টাকা আনবো তা বিদেশে চালান দেবে। বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে।’

দুর্নীতিবাজদের উৎখাতের সেই কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। দুর্নীতি দমনের জন্য প্রতিটি সরকার এরপর ঘোষণা দিয়েছেন বটে, অনেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাও করেছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নাই। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন একটি পক্ষের বিরুদ্ধেই থেকে গেছে সন্দেহের আঙ্গুল। 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়