ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এখনো অনুসরণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ১৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনো অনুসরণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি

হাসান মাহামুদ : ব্যক্তিগত সাফল্য জাতীয় অর্জন ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো উদাহরণ বিশ্বে খুব বেশি নেই। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সেই সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা সরকারপ্রধান বা কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত অসংখ্য কূটনৈতিক অর্জনের উদাহরণের একটি হতে পারে- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করা কূটনীতিকদের সঙ্গে ওইসব দেশের আচরণ। এক্ষেত্রে স্বাধীনতাপ্রত্যাশী বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের পরিচয়ের চেয়ে বেশি কাজ করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এমনকি একটি দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভিসার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো বঙ্গবন্ধুর পরিচয়কে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমানের একটি মতামত উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তরে রিফিউজি হয়ে যখন জার্মানিতে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতাম অন্য দেশে যাওয়ার সময় আমাদের কার্ড দেখে বলতো তোমরা শেখ মুজিবের দেশের লোক, তোমাদের কোন ভিসা লাগবে না।’

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেই কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এজন্য বঙ্গবন্ধুকে বিবেচনা করা হতো বিশ্বের অন্যতম ‘ক্যারিশম্যাটিক ডিপ্লোমেট’ হিসেবে।

বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ায় বিশ্বনেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপের বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রকাশ হয়েছে। এসব আলোকচিত্রে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর মুখের অভিব্যক্তি যেন তাদের সমকক্ষ পর্যায়ের ছিল। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কিংবা তৃতীয় বিশ্বের একজন নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে কখনো মাথা নিচু করে আলাপ করতে দেখা যায় নি। এসবই ছিল তার কূটনৈতিক অর্জন।

মৃত্যূর এতবছর পরেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রসঙ্গ উঠলে তার নেতৃত্বগুণের কথা চলে আসে সবার আগে। তার ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, সম্মোহনী শক্তি নিয়েও বহু লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতার কূটনৈতিক ক্যারিশমার বিষয়টি খুব কমই আলোচনায় এসেছে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র একজন তুখোড় রাজনীতিবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন বিশ্বমানের কূটনীতিকব্যক্তিত্ব। দেশে কিংবা বিদেশে, যখনই কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, দেশের স্বার্থের বিষয়ে কীভাবে তাদের সমর্থন আদায় করে নেওয়া যায় সেটা তিনি ভেবেছেন সবসময়। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক কৌশলের কারণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এমন অনেকেরই সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করা সম্ভব হয়েছিল যারা বাংলাদেশ বিরোধী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক সাফল্য শুধুমাত্র এশিয়া নয় বিশ্বের যেকোনো দেশের সরকারপ্রধান হিসেবে অন্যতম ছিল। মাত্র ৪৪ মাস দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ যে ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাড়িয়েছিল তার অন্যতম কারণ ছিল বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক চমক।  জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে জুলাই ১৯৭৫, মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০টির মতো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সফরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক সফর অনুষ্ঠিত হয়। ওই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতার নানা বিষয়ে ৭০টির বেশি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।

অনেক দেশ ও সংস্থা যেমন—সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইডেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বুলগেরিয়া, বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জাতিসংঘ, ইউনিসেফ, ডাব্লিউএফপি, আইডিএ, ইউএনএইচসিআর প্রভৃতি বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের ঋণ, সাহায্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করে।

বঙ্গবন্ধুর অন্যতম কূটনৈতিক দর্শন ছিল- বহুপাক্ষিকতাবাদ ও শান্তির কূটনীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর দ্বারা  প্রণয়ন করা ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি’র মৌলিক কথা ছিল- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এবং ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান’। স্বাধীনতার এতোবছর পরেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা সেই আদর্শকেই ধারণ করেই আবর্তিত হচ্ছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর সেই দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজের সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এখন সব রাষ্ট্রের সঙ্গেই বাংলাদেশের রয়েছে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক।

পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের গৃহীত সেসব নীতি যা রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে সম্পাদন করে থাকে। অন্য রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে তুলে ধরে।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান চারটি মূলনীতি হলো- ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে, ঠিক এ মতাদর্শই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির জনক।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হবার কারণে বাংলাদেশকে বিভিন্ন মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হতে হয়। এ কারণেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ে পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি হিসেবে বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি ক্ষুদ্র দেশ, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৯/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়