ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মহাকাব্যের বিশ্ব জয়

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ২২ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাকাব্যের বিশ্ব জয়

এসকে রেজা পারভেজ : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সময়ের আবেদন মেনে অনেক ভাষণ এসেছে। সেগুলো বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), জোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন ( যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), উইড্রো উইলসন ( যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হো চি মিনের (ভিয়েতনাম) ভাষণ।

তবে এসব ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়িয়ে গেছে অন্যসব ভাষণকে। ১৮ মিনিটের মহাকাব্যিক এই ভাষণ জয় করেছে পুরো বিশ্ব, পেয়েছে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। আপসের পথে না হেটে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ লোক আত্মোৎসর্গ করেন, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ। সরকারের সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ৭ মার্চের ভাষণ ও এর ইতিহাস সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। তিনি এর ওপর একটি প্রামাণ্য পুস্তিকাও প্রকাশ করেন।

পরবর্তীতে ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি হওয়ার পর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ২০১৫ সালে ইউনেস্কোতে প্রস্তাব পাঠান। একই সময়ে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খানও ইউনেস্কোতে আলাদা প্রস্তাব পাঠান। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, তথ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোর স্থায়ী প্রতিনিধি শহীদুল ইসলামকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর তথ্য মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে পরামর্শ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম দালিলিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ইউনেস্কোতে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন প্রস্তাব পাঠায়। এসব প্রস্তাব দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

ওই বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৭ মার্চের ভাষণকে 'ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে' তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংস্থার ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। ওইদিন প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এ সংক্রান্ত ঘোষণা দেন।

১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা-বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দালিলীক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

এর ফলে বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রণোদনা সৃষ্টিকারী ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হল। স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকৃত ৩০ লাখ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোনসহ আমাদের সবার জন্য এটি এক মহা-আনন্দ ও বিরল সম্মানের বিষয়।

অবিভক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মানুষ অপেক্ষায় ছিল-বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কী বলেন। ঢাকায় তখন বিদেশি সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়েছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল এক অন্তিম মুহূর্ত। অপরদিকে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান। এর পটভূমিতে ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা।

তার প্রিয় সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর ‘মুজিব কোট’ পরে এলেন মঞ্চে। সামনে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা। কি বলবেন প্রিয় নেতা। এমনই এক সন্ধিক্ষণে তিনি ১৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত অথচ জগদ্বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেন। অসাধারণ এর বক্তব্য। যেমন সারগর্ভ, তেজস্বী, যুক্তিযুক্ত, তেমনি তির্যক, তীক্ষ্ণ ও দিকনির্দেশনাপূর্ণ। অপূর্ব শব্দশৈলী, বাক্যবিন্যাস ও বাচনভঙ্গি।

ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো ... আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। ... রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।’

৭ মার্চের ভাষণের মূল কয়েকটি দিক হচ্ছে- সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা; নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা; পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত; সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান; অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলার হুমকি; দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহ্বান।

বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ও আলোচিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। এমনকি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ভাষণটি। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৯/রেজা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়