ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘সচেতনতাই করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পারে’

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৭ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সচেতনতাই করদাতার সংখ্যা বাড়াতে পারে’

নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলে করদাতার সংখ্যা বাড়বে। এজন্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষের কাছে কর দেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগ যত নেওয়া যাবে প্রান্তিক পর্যায়ে করদাতা তত বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া প্রাথমিক স্তর থেকে পাঠ্যপুস্তুকে আয়কর বিষয়ের প্রাথমিক ধারণা যোগ করা যেতে পারে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা এলে প্রকৃত করদাতার সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

রাইজিংবিডির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন তরুণ আয়কর আইনজীবী মো. ইমরান গাজী। তিনি ২০১৩ সাল থেকে কর আইনজীবী হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তথ্য ও প্রযুক্তিভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি যশোরের অভয়নগরে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির সিনিয়র রিপোর্টার এম এ রহমান মাসুম।

রাইজিংবিডি: দেশে করদাতা হিসেবে ইটিআইএনধারী লোকের সংখ্যা ৩৬ লাখ হলেও আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন ১৪ লাখের কিছু বেশি করদাতা। অর্থাৎ প্রকৃত করদাতা সেই অর্থে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কেন?
মো. ইমরান গাজী:
ইটিআইএন ও আয়কর রিটার্ন জমাদানকারী সংখ্যা হিসাব করলে দেখা যায় ২০ লাখের মতো মানুষ প্রকৃত আয়কর জমা দিচ্ছেন না। আমি মনে করি রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিটি অঞ্চলকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে স্পট অ্যাসেসমেন্ট করলে ইটিআইএন গ্রহণকারীর সংখ্যা যেমন বাড়ানো সম্ভব তেমনি রিটার্ন দাখিল করার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। যেমন ঢাকা নগরীতে যারা ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তারা প্রত্যেকেই করযোগ্য আয় করেন। কিন্তু তাদের অনেকেই আয়কর দেন না। শুধু এই খাত থেকেই ৫০ লাখ করদাতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এছাড়া ঢাকা নগরীর প্রত্যেক ব্যবসায়ী করযোগ্য আয় করেন। এমনকি একটি চায়ের দোকানদারও করযোগ্য আয় করেন। অনেক ছোট দোকানদার তো মাসেই আড়াই লাখ টাকা আয় করেন। কিন্তু তারা করের বাইরে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি সেলুনকে চিনি যার বছরে আয় আছে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। সে কিন্তু কর দেয় না। সেলুনের আবার ট্যাক্স কিসের তারা এমনটাই মনে করে।

রাইজিংবিডি: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে একটি শ্লোগান প্রচলিত রয়েছে। সেটা হলো-‘দেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ হোন, আয়কর দিন, কর দেওয়া ঈমানি দায়িত্ব ইত্যাদি। আসলে প্রকৃত পক্ষে এ ধরণের শ্লোগান রাজস্ব আদায়ের কতটুকু অবদান রাখে?
ইমরান গাজী: আসলে আমরা বেশিরভাগ মানুষই কর ফাঁকি দেওয়ার পক্ষে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কর দেওয়ার কথা বলি, প্রকৃতপক্ষে এর বাস্তবায়ন খুব কম। এগুলো বেশিরভাগই মুখের কথা। এর পেছনে বড় কারণ সরকারের প্রচারের অভাব। কর আদায় করতে হলে এলাকা ভিত্তিক যথাযথ জরিপের প্রয়োজন। যেমন ধরেন খিলগাঁও এলাকায় কতজন বসবাস করেন, কত শতাংশ কর দেন এবং কত শতাংশ দেন না। এ সম্পর্কে এনবিআরের কাছে কোনো পরিসংখ্যান পাবেন না। ফলে করদাতার সংখ্যা কীভাবে বাড়বে?

রাইজিংবিডি: ব্যাপক প্রচারণা ও মাঠ পর্যায়ে করদাতা বৃদ্ধিতে কাজ করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এনবিআর সব সময় লোকবল ঘাটতির কথা বলে থাকে। এর সঙ্গে আপনি কতটুকু একমত?
ইমরান: এটা কোনো ‍যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নয়। কারণ, নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে তাদেরকে প্রকৃত কাজ বের করে আনতে হবে। শুধু সরকার সবকিছু করে দেবে এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এনবিআর চাইলে একটি বেসরকারি কোম্পানিকে কর জরিপের দায়িত্ব দিতে পারে। যারা এলাকা ভাগ করে প্রকৃত করদাতা ও করের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর বিষয়ে জরিপ আকারে এনবিআরকে তথ্য দেবে। যেমন: আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি একটি কোম্পানি নতুন পণ্য বাজারে আনার আগে জরিপ করে। সেক্ষেত্রে জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে থাকে। আসলে সবার আগে দরকার প্রকৃত সদিচ্ছা। আমি এখানে সদিচ্ছার ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স বা টেলিফোন লাইন নিতে যেমন ইটিআইএন নেওয়া বাধ্যতামূলক তেমন কিছু ক্ষেত্র যোগ করে করদাতা বৃদ্ধি করতে পারে সরকার।

রাইজিংবিডি: কোন পদক্ষেপে করাদাতা আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?
ইমরান:
প্রথমত সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষের কাছে কর দেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই ধরনের উদ্যোগ যত নেওয়া যাবে প্রান্তিক পর্যায়ে করদাতা তত বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া প্রাথমিক স্তর থেকে পাঠ্যপুস্তুকে আয়কর বিষয়ের প্রাথমিক ধারণা যোগ করা যেতে পারে। তাহলে শিশুরা জানবে আয়কর কি? কেন দিতে হবে? কারণ, এরাই ভবিষ্যত করদাতা।

রাইজিংবিডি: ইটিআইএন নেওয়ার পরও কেন অনেক মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করছে না?
ইমরান:
আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ বেশি কর হার। আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এতে কর হার কমিয়ে স্ল্যাব বাড়ানো যেতে পারে। তাহলে করভীতি যেমন কমে আসবে তেমনি করদাতার সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এর সঙ্গে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে শাস্তির বিধানকে আরো কঠোর করা যেতে পারে।

রাইজিংবিডি: এবার আয়কর মেলা ও নির্ধারিত সময়ে আয়কর রিটার্ন দাখিলের পরিমাণ কতটা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ইমরান: গত অর্থবছরে ১৪ লাখের কিছু বেশি মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। এবার আশা করছি ১৮ থেকে ২০ লাখ করদাতা রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। আমরা নিজেরাই দেখেছি, নতুন নতুন করদাতা আসছেন যারা আমাদের কাছ থেকে আইনি সহায়তা নিচ্ছেন। অর্থাৎ করদাতার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাইজিংবিডি: অনেক করদাতা আছেন ১০ লাখ টাকা আয়কর দেওয়ার মতো আয় করেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি কর দেন ২ লাখ টাকা। কর ফাঁকির এ প্রবণতার পেছনের কারণ কি?
ইমরান: আসলে কর ফাঁকি দিয়ে সহজে পার পাওয়া যায় না। অনেক সময় আমরা দেখেছি আয়কর রিটার্ণের তথ্য যাচাইয়ে নূন্যতম ছয় বছর পেছনের হিসাব টেনে এনে তার করযোগ্য আয় বের করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ কর ফাঁকি দিয়েও সে পার পাচ্ছে না। এক সময় সে ধরাই খাচ্ছে। আর কর ফাঁকি দেওয়ার বড় একটি কারণ ঘুষ-দুর্নীতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কর ফাঁকি দেওয়া হয়ে থাকে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো শাস্তি না হওয়া। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করেন সরকারি চাকুরি যায় না। যদি ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে চাকুরি যেতো তাহলে হয়রানি করার প্রবণতা হ্রাস পেতো। ঘুষ-দুর্নীতি কমে আসতো।

রাইজিংবিডি: কর ফাঁকির পেছনে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কর আইনজীবী বড় ভূমিকা পালন করে থাকেন। এর সঙ্গে আপনি কতটুকু একমত?
ইমরান: দ্বিমত পোষণ করা সুযোগ নেই। তবে এনবিআর অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার যে সুবিধা চালু করেছে, তাতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আর থাকবে না। সামনে অনলাইন সিস্টেম আরো আধুনিক হবে। সেক্ষেত্রে এ ধরণের অবৈধ সুযোগ কমে আসবে।

রাইজিংবিডি: অর্থমন্ত্রী একটি কথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ করযোগ্য আয় করেন। কিন্তু বাস্তবে তার সংখ্যা অনেক কম- এ বিষয়ে আপনি কি একমত?
ইমরান: মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। পেশাগত দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে বলতে পারি বাংলাদেশে জজ কোর্ট ও হাই কোর্টসহ কোর্টগুলোতে যত আইনজীবী রয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ আইনজীবী আয়কর দেন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই করযোগ্য আয় করেন। আয়কর দিতে হবে- এই প্রবণতাও তাদের মধ্যে নেই। এমন প্রবণতা ব্যবসায়ী কিংবা চাকুরিজীবীর মধ্যেও রয়েছে। এই প্রবণতা যখন কমে আসবে তখন রিটার্ন দাখিল করার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এক কোটি হবে। ইটিআইএনধারী হবে আরো অনেক বেশি। স্পট অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে মফস্ব:ল শহরেও করদাতা অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

রাইজিংবিডি: এনবিআরে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের যে সিস্টেম রয়েছে সেখানে আপনাদের সন্তুষ্টি কতখানি?
ইমরান: আমরা খুব বেশি অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করিনি। যে কয়টি করেছি সেখানে কোনো অসুবিধা পাইনি।

রাইজিংবিডি: এনবিআর যে আয়কর মেলার আয়োজন করে সে মেলা নিয়ে কর আইনজীবী হিসেবে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট?
ইমরান: আয়কর মেলায় যতটুকু সেবা দেওয়া হয় তা নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটামুটি সন্তুষ্ট। তবে করদাতা সেবায় আরো কিছু বুথ যোগ করা যেতে পারে। যেমন ধরুন- কর অঞ্চল পরিবর্তন ও নামের বানান সংশোধন এ রকম কিছু সেবা দিতে বুথের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। এর সঙ্গে আয়কর মেলার সময় ও পরিধি বৃদ্ধি করা যেতে পারে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ নভেম্বর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়