ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘অস্ত্রের মুখে ওরা আমার স্বামীকে বলল সঙ্গে যেতে’

সিয়াম সারোয়ার জামিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘অস্ত্রের মুখে ওরা আমার স্বামীকে বলল সঙ্গে যেতে’

ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীর সঙ্গে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। তিনি শহীদজায়া হিসেবেই পরিচিত। ১৯৪২ সালে জন্ম নেয়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী স্বামীর সঙ্গে মু্ক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ঢাকার পুরানা পল্টনে। সে সময় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করেছেন। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা আগে আলীম চৌধুরীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। তিনি আর ফিরে আসেননি। এই কথোপকথনে উঠে এসেছে দুঃসহ সেই বেদনা-বিমূঢ় স্মৃতি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিয়াম সারোয়ার জামিল।

রাইজিংবিডি: ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীকে শেষ কবে দেখেছিলেন?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ওরা বাসায় আসে। মওলানা আব্দুল মান্নান (আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক, পরবর্তীকালে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক) আমাদের বাসার নিচতলায় থাকত। আমার স্বামীই তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ওরা আমাদের দরজায় নক করল। আমি আলীমকে বললাম, ওরা দরজায় নক করছে। তখন আলীমের মুখটা কালো হয়ে গেল! পেছন দিয়ে বেরুনোর একটা সিঁড়ি ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে যাতে আমাদের বাসায় আসতে পারে, সেজন্য সবসময় সিঁড়ির দরজা খোলা রাখতাম। সেই সিঁড়ি দিয়ে যখন আমি মান্নানকে ডাকলাম তখন সে বলেছিল, আপনি যান। আমি আছি।  ভয় নেই। পরে সেই দরজা দিয়েই আলীম নিচে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু মান্নান সেদিন ভেতর থেকে নিচের দরজা বন্ধ করে চুপ করে নিজের ঘরে বসে ছিল। অস্ত্রের মুখে তারা আমার স্বামীকে বলল, তাদের সঙ্গে যেতে। তিনি বললেন, কাপড়টা পরে আসি। তিনি কাপড় পরলেন। ওরা বলল, কাজ শেষ হলে ফেরত দিয়ে যাব। সেই যে গেল চলে আসবে বলে, আর এলো না। আমি অপেক্ষায় থাকি। প্রহর গুনি। কিন্ত আর এলোই না।

রাইজিংবিডি: পরে তাঁকে কীভাবে কোথায় পেলেন?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: আলীমের লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। ডা. ফজলে রাব্বির পাশে তাঁকেও দুচোখ বেঁধে, হাত বেঁধে বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করা হয়। আমি কখোনই এ কথাটি ভুলতে পারি না, ওকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল ওঁর তখন কী মনে হয়েছিল? কেমন লেগেছিল?

রাইজিংবিডি: ওই সময় ঢাকার অবস্থা কেমন ছিল?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: তখন ঢাকা একেবারেই সুনসান। কারফিউ চলছে। এর মধ্যেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছি৷ গোপনে টাকা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছি। খাবার ওষুধও সংগ্রহ করেছি৷ মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে যেত৷ বিভিন্ন কারখানা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি৷ মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য নিজ হাতে সোয়েটার বুনেছি। আমাদের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসব শীতের কাপড় নিয়ে যেত৷ আসলে বাসার নিচতলায় ছিল আলীমের ক্লিনিক। ২৫ মার্চের পরেই ক্লিনিক বন্ধ করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাপ-আলোচনা, পরিকল্পনা, আহতদের সেবা এবং আশ্রয়ের কাজে ব্যবহার করা হতো। এভাবেই চলছিল।

রাইজিংবিডি: বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হতে দীর্ঘ চার দশক সময় লেগেছে। কীভাবে এতদিন লড়াই চালিয়ে গেছেন?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের দেশে পুনর্বাসিত করেছেন জিয়াউর রহমান। একজন রাজকারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন তিনি। এরশাদও এদের বিচার করেননি, জিয়ার নীতি অনুসরণ করেছেন। ২০০২ সালে নিজামী-মুজাহিদকে ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়েছেন খালেদা জিয়া। মন্ত্রী বানিয়ে এদের গাড়িতে জাতীয় পতাকাও ওড়ানো হয়েছে। এগুলো দেখে আমরা ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু দমে যাইনি। বিশ্বাস রেখেছিলাম, একদিন বিচার হবেই। লড়াই জারি রেখেছিলাম। আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম।

রাইজিংবিডি: আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষীও দিয়েছেন। সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই এমন ভাব করেছে, যেন তাদের কোনো অপরাধ নেই। তারা খুবই নিরীহ, কিছুই করেনি। রায় হওয়ার পরেও মুজাহিদ তার ছেলেকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে, তার কোনো দোষ নেই, সে নির্দোষ। তাকে যে বিচার করা হয়েছে তা অন্যায় বিচার। কত বড় ধৃষ্টতা!

রাইজিংবিডি: যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে কতটা সন্তষ্ট?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: এতটুকুই বলতে চাই, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি কথা দিয়েছিলেন- বিচার করবেন। তিনি কথা রেখেছেন। আমরা তার প্রতি সন্তষ্ট।

রাইজিংবিডি: ডা. আ ফ ম আবদুল আলীম চৌধুরীর স্বপ্ন কী ছিল?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: তার স্বপ্ন ছিল, দেশের মানুষকে পাকিস্তানের শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করা। তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি সবসময় দরিদ্র মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় ভাবতেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতেন। আলিম পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আফসোস, তিনি দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না।

রাইজিংবিডি: মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর পর এখন লড়াইটা কীভাবে জারি রাখতে চান?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: গোটা জাতির মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তুলতে এবং প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে আমরা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি৷ এই লড়াই জারি রাখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও দেখে খারাপ লাগে যে, সবার মাঝে একই রকমভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কাজ করে না। দেশকে সবাই ভালোবাসে না। দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেয়ার লড়াইটাকে আমাদের একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে।

রাইজিংবিডি: সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা করেন?

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী: মুজিব সরকারের আমলে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ছিল। মাত্র ক’জনের বিচার হয়েছে। সবার তো বিচার হয়নি। এদের খুঁজে বের করে যতটা সম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারগুলো করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। এই বিচার প্রক্রিয়া যেন থেমে না যায়। এই প্রক্রিয়া অবশ্যই চলমান রাখতে হবে।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়