গুলশান হামলা : তদন্তে মালয়েশিয়া-স্পেন যাচ্ছে সিটিটিসি
নিজস্ব প্রতিবেদক : গুলশানের হলি আর্টিজান রেঁস্তোরায় জঙ্গি হামলা মামলার তদন্তে মালয়েশিয়া ও স্পেনে যাচ্ছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা।
হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত মালয়েশিয়ার স্থানীয় ও অন্যান্য জঙ্গিদের (বিদেশি) বিষয়ে তদন্ত করতে সে দেশে যাচ্ছে সিটিটিসি। সেখানে গিয়ে নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলামের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বাংলাদেশির (জঙ্গি) বিষয়ে তদন্ত করা হবে।
একই সঙ্গে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাসহ বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থায়নের উৎসের সন্ধানে যাওয়া হচ্ছে স্পেনের পুয়েতা মেরিডায়। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমে অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী পলাতক মো. আতাউল হক সবুজের হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকার বিষয়ে সার্বিক তদন্ত করা হবে। ইতিমধ্যেই ইন্টারপোলের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির পরিদর্শক মো. হুমায়ন কবির মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন। সোমবার ওই আবেদন মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম নূরুন্নাহার ইয়াসমিন।
মূলত গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা মামলায় নির্ভুল অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য তদন্তের শেষের দিকে কর্মকর্তারা বিদেশি জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি জঙ্গিবাদে অর্থায়নের বিষয়টিও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে যাচ্ছেন। সিটিটিসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জঙ্গি গোষ্ঠীর সন্ধানে মালয়েশিয়ায়
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় যারা অংশ নিয়েছে তাদের অন্যতম নিবরাস ইসলাম। ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ডা. আজমল হোসেনের ছেলে তৌসিফ হোসেন (৪২)। নিবরাস ও তৌসিফ ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ’তে পড়ত। ওই সময় তারা (নিবরাস ও তৌসিফ) জঙ্গিবাদে জড়িত হয়। তারা যে জঙ্গি গোষ্ঠীতে সম্পৃক্ত হয় তার সঙ্গে মালয়েশিয়ার স্থানীয়দের যোগাযোগ ও মদদ ছিল। তারা অন্য জঙ্গিদের অনুপ্রেরণায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। মালয়েশিয়ায় জঙ্গি সংগঠনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলার দীক্ষা নেয়। এরপর তারা বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন হামলায় অংশ নেয়।
এ ছাড়া রাজধানীর বনানীর ডিওএইচএস এলাকায় বসবাসরত নিবরাসের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। তাদের অনেকের পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি। মূলত নিবরাস ও তৌসিফ মালয়েশিয়ায় থাকাকালে কাদের সঙ্গে মিশে জঙ্গি হয়েছিল, তারা কোথায় কাদের সঙ্গে সেখানে থাকত, কে কে তাদের কাছে আসত, তাদের দৈনন্দিন কাজের ধরণ কেমন ছিল, এসব বিষয়ে সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করাসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে তদন্তে সিটিটিসি মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসি পরিদর্শক মো. হুমায়ন কবির তদন্তের স্বার্থে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে এবং সেখানে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। সোমবার ওই আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকা মহানগর হাকিম নূরুন্নাহার ইয়াসমিন তাকে মালয়েশিয়ার যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আদালত মালয়েশিয়ার তদন্ত সংস্থার প্রতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করেছেন।
জঙ্গি কার্যক্রমের অর্থের উৎসের সন্ধানে স্পেনে
বাংলাদেশের জঙ্গি কার্যক্রমে অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া থানার পাকুরিয়া গ্রামের মো. আতাউল হক সবুজ (৩৯)। ইন্টারপোলের মাধ্যমে সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, সবুজের স্ত্রী আনা মারিনা গঞ্জালেস গার্সিয়া স্পেনে রয়েছেন। তিনি স্পেনের ইবাক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার জন্য সবুজ হুন্ডির মাধ্যমে স্পেন থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিদের কাছে ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা পাঠান। সবুজের অর্থ পাঠানোর স্থান পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তের জন্য সিটিটিসিকে স্পেনে পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে রোববার জঙ্গি অর্থায়নের ওই টাকা জব্দে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির এসআই মো. আজগর আলী তদন্তের স্বার্থে স্পেনে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সেখানে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। ওই দিনই ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সাঈদ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে স্পেনে যাওয়ার অনুমতি দেন। আদালত তার আদেশে স্পেনের তদন্ত সংস্থার প্রতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতার অনুরোধ জানান।
দীর্ঘদিন নজরদারি করে সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানতে পারেন মো. আবুল হাসনাত, মো. নাহিদুদ্দোজা মিয়া, মো. নাহিদুল ইসলাম, মো. তাজুল ইসলাম ওরফে শাকিল, হাসানুল হক গালিব জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। জঙ্গি সংগঠনের জন্য তারা সদস্য সংগ্রহ, অর্থায়ন ও অর্থ সংগ্রহ করে। রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতা করার জন্য তেজগাঁও থানাধীন কাওরানবাজার টিসিবি ভবনের পাশে ২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর তারা জমায়েত হওয়ার পরিকল্পনা করে। এ সংবাদের ভিত্তিতে কৌশলগতভাবে অবস্থান নিয়ে ওই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অজ্ঞাত আরো কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গ্রেপ্তার জঙ্গি আবুল হাসনাতের দেহ তল্লাশি করে ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবুল হাসনাত জানায়, তার দুই ছেলে মো. সিফুল হক সুজন (পলাতক) ও আতাউল হক সবুজ (পলাতক) বিদেশে থাকে। কয়েক দিন আগেই তারা মতিঝিলের বিনিময় মানি এক্সচেঞ্জের জনৈক আনোয়ারের মাধ্যমে জঙ্গি মো. নাহিদুদ্দোজা মিয়ার কাছে ওই টাকাগুলো পাঠায়। জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, বিশেষ করে বড় ধরনের নাশকতা করার জন্য ওই টাকাগুলো পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের পরের দিন সিটিটিসি পরিদর্শক কবির হোসেন বাদী হয়ে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলাটি দায়ের করেন। গুলশান হামলায় জঙ্গিরা একে অপরের সঙ্গে থ্রিমা অ্যাপস দিয়ে যোগাযোগ করেছিল। এ মামলার এজাহারেও বলা হয়, আসামিরা একে অপরের সঙ্গে থ্রিমা অ্যাপস ব্যবহার করে যোগাযোগ করে।
প্রসঙ্গত, গত বছর ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় অস্ত্রধারী জঙ্গিরা হামলা করে। তারা দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। এ সময় অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন। রাতের বিভিন্ন সময় তিন বাংলাদেশিসহ ২০ জন জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা।
পরের দিন সকালে যৌথ বাহিনী কমান্ডো অভিযান চালায়। এতে হামলাকারীরা নিহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৩ জিম্মিকে।
ওই ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা, ১৮ বিদেশি, দুই বাংলাদেশি ও পাঁচ হামলাকারীসহ ২৮ জন নিহত হয়।
গত বছরের ৪ জুলাই নিহত ৫ জঙ্গিসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের ঢাকা মহানগর কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এ মামলায় এখন পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক হাসনাত করিম, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাজীব গান্ধী, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৭/মামুন খান/রফিক
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন