ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জোড়া খুন : রনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জোড়া খুন : রনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর ইস্কাটনে জোড়া খুনের মামলায় প্রাক্তন সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া, তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে তাকে আরো ছয় মাস কারাভোগ করতে হবে।

বুধবার দুপুরে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল ঈমাম এ রায় ঘোষণা করেন।

আসামি বখতিয়ার আলম রনিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কারাগার থেকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। ২টা ৪৮ মিনিটের দিকে রনির মামলার রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। এ সময় রনি কাঠগড়ায় উঁচু হয়ে বিচারকের রায় পড়া শুনতে থাকেন। কিছুটা উতলা দেখা গেলেও বিমর্ষ ছিলেন না রনি। 

আদালত মামলার ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য, তদন্ত কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনার দিন রনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় মদ পান করেছিলেন। রনি এবং তার ড্রাইভার ইমরান ফকিরের কললিস্ট এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সামনের সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ঘটনার সময় এ মামলার আসামি রনির বহনকৃত গাড়িটি ৫ মিনিট আগে ইস্কাটন রোড দিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে যায়। ঘটনার ১০ মিনিট পর একই রাস্তা দিয়ে গাড়িটি ফিরে আসে।

বিচারক বলেন, রনির গাড়ির চালক ইমরান ফকির, ওই দিন তার (বখতিয়ার আলম রনি) সঙ্গে থাকা কামাল মাহমুদ, টাইগার কামাল এবং জাহাঙ্গীর আলম আদালতে ১৬৪ ধারায় সেদিনের ঘটনার জবানবন্দি দেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বখতিয়ার আলম রনি তার পিস্তল দিয়েই গুলি ছোড়েন। এই গুলিতেই রিকশাচালক হাকিম ও সিএনজি অটোরিকশা চালক ইয়াকুব গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

বিচারক আরো বলেন, রনি যে পিস্তল ব্যবহার করেছেন তার লাইসেন্স ছিল কি না, সেই মূল কপি আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। কতটি গুলি আসামি ব্যবহার করতে পারবেন সেই হিসাবের বিবরণও আদালতের কাছে দেওয়া হয়নি। তবে পুলিশ ২১টি গুলি আসামির কাছ থেকে উদ্ধার করেছিল, এ তথ্য উঠে আসে। তবে তার পিস্তল থেকে ছোড়া গুলিতে দুটি নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে গেছে, তা সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে। আসামি জানতেন, পিস্তল দিয়ে ছোঁড়া গুলিতে প্রাণহানি ঘটতে পারে। তাই এর দায় আসামি এড়াতে পারেন না। ঘটনায় শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, কিন্তু ঘটনার সময়ে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

আদালতে নিহত রিকশাচালক হাকিম ও সিএনজি অটোরিকশা চালক ইয়াকুবের পরিবারের কাউকে দেখা যায়নি। তবে নিহত অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলীর স্ত্রী সালমা বেগম মোবাইল ফোনে বলেন, পেশকার আমাকে বলেছেন, ৩১ তারিখে রায়। সে আমারে মিথ্যা কইল ক্যান? আমি কেমনে খুশি হই? আমি কী পাইলাম? সে (আসামি) তো আপিলে বের হয়ে যাবে।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর এস এম জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা সবাই এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। ন্যক্কারজনক এ ঘটনার সুন্দর, সুষ্ঠু বিচার হোক, আমরা সবাই প্রত্যাশা করেছিলাম। আদালত আজ রায় দিয়েছেন। যতটুকু করার চেষ্টা করে রাষ্ট্রপক্ষ সেই কাজটি করতে পেরেছি, মামলাটি প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছি।

তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, ব্যক্তি নয়, পদ নয়, কারো যদি মামলার সংশ্লিষ্টতা থাকে সে যেই হোক তার ন্যায়বিচার এ সরকারের আমলে হবে। আপনারা সবাই আসামি সম্পর্কে জানেন, আমি আর নতুন করে কিছু বলতে চাই না। আনন্দের সাথে বলছি, মামলাটি আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। অনেক বাধা-বিপত্তি, অনেক কিছুর পরও মামলাটি শেষ করতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। রায় দেখে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপে নেওয়া হবে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষ ২৪ জনকে আদালতে উপস্থাপন করেছে। আমরা ২৪ জনকে জেরা করেছি। কোনো সাক্ষী বলেলনি, রনি গাড়ি থেকে গুলি ছুঁড়েছেন। তারপরও তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন। আমরা মনে করি , ন্যায়বিচার পাইনি, আমরা সংক্ষুদ্ধ। জাজমেন্ট দেখে উচ্চ আদালতে আপিল করব।   

কোনো সাক্ষী ছিল না, তবে রনির সঙ্গে যারা ছিল, তারা বলেছেন, রনির পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। সাংবাদিকদের এমন কথার জবাবে ওমর ফারুক বলেন, মামলাটি তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা তাদের ফোর্স করল, তোমাদের আসামি করব। ভয় দেখিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তাদের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিলেন। ওই আদালতে  তারা বলল, রনি গুলি করেছে। কিন্তু বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যে তারা কেউ বলেনি, রনি গুলি করেছে।

গত ১৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের এ তারিখ ঠিক করেন আদালত।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে একটি কালো রঙের প্রাডো গাড়ি থেকে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়লে অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম আহত হন। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা মারা যান। এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে রমনা থানায় ১৫ এপ্রিল একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

ওই বছরের ৩০ মে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে বখতিয়ার আলম রনিকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই রয়েছেন।

মামলাটিতে ২০১৫ সালের ২১ জুলাই ডিবি পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস রনির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৬ সালের ৬ মার্চ মামলাটিতে এ আসামির অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে আদালত চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন। মামলাটির বিচারকালে আদালত ৩৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের ২৯ অক্টোবর আসামি রনি আত্মপক্ষ শুনানিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জানুয়ারি ২০১৯/মামুন খান/ইভা/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়